আজিজুল হাকিম, মানিকগঞ্জ
ঐতিহ্য
ধ্বংসের পথে ‘ঝিটকা পোদ্দারবাড়ি’
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ঝিটকার বাল্লা অঞ্চলের ধনাঢ্য পরিবারখ্যাত পোদ্দারবাড়ির কর্ণধার ছিলেন মহারাজ পোদ্দার
বাড়িটিতে ঢুকতেই সবুজ মাঠের দক্ষিণ পাশে পুকুরের দৃষ্টিনন্দন ঘাট। এর পাশে বিশাল চৌচালা ঘর। ঘরটির চাল টিনের হলেও চারপাশের দেয়াল কাঠের। চারপাশের বারান্দাও কাঠের তৈরি। এই ঘরেই বিচার-সালিশ হতো। এর উত্তর পাশে পূর্ব-পশ্চিমে দৃষ্টিনন্দন বিশাল আধাপাকা ঘর। এর পেছনে অর্থাৎ উত্তর পাশে আছে দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্বমুখী কারুকার্যখচিত তিনটি প্রাসাদ। একতলাবিশিষ্ট প্রতিটি প্রাসাদে চার থেকে পাঁচটি করে বিশাল কক্ষ। এই প্রাসাদেই থাকতেন পোদ্দারবাড়ির সদস্যরা। তবে সংস্কারের অভাবে প্রাসাদগুলো সৌন্দর্য হারিয়ে এখন ধ্বংসের পথে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ঝিটকার বাল্লা অঞ্চলের ধনাঢ্য পরিবারখ্যাত পোদ্দারবাড়ির মূল কর্ণধার ছিলেন মহারাজ পোদ্দার। আর মহারাজ পোদ্দারের ছিল দুই ছেলে- রাম মোহন পোদ্দার ও আনন্দ মোহন পোদ্দার। আনন্দ মোহন পোদ্দারের ছিল তিন ছেলে। যোগেশ্বর পোদ্দার, সর্বেশ্বর পোদ্দার ও হরমোহন পোদ্দার পিতামহ ও পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৭ একর জমির ওপর উনিশ শতকের শুরুর দিকে দৃষ্টিনন্দন বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলেন। মূলত হরিরামপুরের ঝিটকা এলাকার ইছামতী নদীর কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা ঝিটকাহাট ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে উনিশ শতকের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে ৭ একর জমির ওপর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করেন তিন ভাই। তারপর থেকেই এটি ঝিটকা পোদ্দার বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
এ ছাড়া ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনের পর আনন্দ মোহন পোদ্দারের বংশধররা স্বপরিবারে ভারতে চলে গেলেও রাম পোদ্দারের বংশধররা ঝিটকা থেকে যায়। এরপর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার আনন্দ মোহন পোদ্দারের বংশধরের ৭ একরের বাড়িটি অধিগ্রহণ করে নেয়। ফলে ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়ির দক্ষিণের ঘরটিতে সার্কেল অফিসের (রাজস্ব) কাজ শুরু করেন। যা বর্তমানে বাল্লা ইউনিয়নের ভূমি অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পোদ্দার বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প করা হয় এবং আগস্ট মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ক্যাম্প পরিচালিত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও বহন করে পোদ্দার বাড়িটি।
এ ছাড়া দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার মধ্যে পাকা ও অর্ধপাকা বাড়ি, বাড়িটির দক্ষিণ ও উত্তর পাশে দুটি বিশাল পুকুর, দক্ষিণ পাশে পুকুরটি গোসলের জন্য তৎকালীন সময়ে দৃষ্টিনন্দন শান বাঁধাই ঘাটসহ ছোট-বড় বাংলো ঘর উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বাড়ির পূর্ব পাশে রয়েছে দিগন্ত জোড়া সবুজ ফসলের মাঠ।
যাতায়াত : রাজধানীর গাবতলী থেকে সড়কপথে ঝিটকা পোদ্দার বাড়িতে পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগে। হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক হয়ে অথবা গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা থেকে সরাসরি ঝিটকা বাজার। আর ঝিটকা বাজার এক কিলোমিটার সামনে গেলে রাস্তার ডান পাশে চোখে পড়বে ঝিটকা পোদ্দার বাড়ি। প্রতিদিন জেলা ও জেলার বাইরে থেকে দর্শনার্থীর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পোদ্দার বাড়ি দেখতে আসেন।
পোদ্দার বাড়িতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী সুমন রহমান বলেন, জায়গাটা খুব সুন্দর ও মনোরম। গ্রামীণ পরিবেশে অসাধারণ একটা পরিবেশ। পোদ্দার বাড়ির কথা অনেকবার বন্ধুদের মুখে শুনেছি। এর আগেও কয়েকবার এসেছি। এবার পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছি। তবে বাড়ির যে প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, সেটি ধরে রাখতে হবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জব্বার মিয়া বলেন, আমি জন্মের পর থেকে বাড়িটি দেখে আসছি। এখানে আগে পোদ্দার পরিবারের লোকজন বাস করতেন, কিন্তু এখন আর কেউ বসবাস করে না। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে বেড়াতে আসেন। পোদ্দার বাড়ির কারণে আমাদের এলাকার নাম আরো পরিচিত হয়েছে। বাড়িটি আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। তবে অযত্ন আর অবহেলার কারণে বাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাড়িটি হয়তো একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ ছাড়া পোদ্দার বাড়িতে মানুষ শুটিং করতে আসেন। বিভিন্ন সময় বড় গানের আসর বসে। বিকেল হলে এলাকার লোকজন আড্ডা দেয়। ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। আবার বাড়ির পাশে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মোটকথা হচ্ছে, বাড়ির ইতিহাস বিবেচনা করে, বাড়িটি সংস্তার বা মেরামত করা উচিত। এ বিষয়ে হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন, পোদ্দার বাড়ির বিষয়ে সংস্কৃত মন্ত্রণালয়ে একটা ডিজাইন পাঠিয়েছি। কিন্তু সেখান থেকে এখনো কোনো ফিডব্যাক পাইনি। তবে ঐতিহাসিক পোদ্দার বাড়ি নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। সে বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা হবে।
"