প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
তামিম আমজাদ শাকিলের গল্প
কাটতে হয়েছে পা, মেরুদণ্ডে বুলেট, ছররায় অন্ধত্ব
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
‘আমার এখনো মনে হয় যে, আমার পা আগের মতোই আছে। এটা যে কেটে ফেলা হয়েছে, এটা যে নেই সেটা মনেই থাকে না। আমি পুরো পায়ের অনুভূতি আগের মতোই পাই।’ ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় বসে কথাগুলো বলছিলেন ১৫ বছর বয়সি কিশোর তামিম হোসেন। ছররা গুলির আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন আমজাদ, মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ গাজীপুরের শাকিলের জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তার অমানিসা। তবে তিনজনই বলছেন, নিজের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে ফেলে তাদের এই রক্ত দেওয়া দেশের ভবিষ্যতের জন্য। তারা সুন্দর ও শান্তির দেশ প্রত্যাশা করেছেন। তারা তিনজনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে। খবর বিবিসির। গত ৫ আগস্ট বিকেলে ঢাকার মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। চিকিৎসকরা তার এই গুলিবিদ্ধ পা কেটে ফেলে তাকে বাঁচিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মিরপুরে যে আনন্দ মিছিল হয়, সেটাতে অংশ নিয়েছিলেন তামিম হোসেন। একপর্যায়ে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়লে একটি গুলি এসে পায়ে লাগে তামিমের। এসব পরিবার কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে জুলাই এবং আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অনেকে যেমন মারা গেছেন, তেমনি তামিমের মতো আহতও হয়েছেন কয়েক হাজার। এদের কেউ গুলিতে চোখ হারিয়েছেন, কেউ পা হারিয়েছেন আবার কেউ শরীরে বুলেট নিয়েই বেঁচে আছেন না বাঁচার মতোই। তাদের পরিবারও আছে দুর্দশার মধ্যে। আহতদের কেউ হাসপাতাল ছেড়েছেন। আবার এক মাস পরও সুস্থ না হওয়ায় অনেকের ঠিকানা হয়েছে হাসপাতাল।
ঢাকার তামিম হোসেন পড়তেন একটি হাফেজি মাদরাসায়। চলতি বছর মাদরাসায় থেকে ভর্তি হয়েছিলেন একটি মাধ্যমিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। গত ৫ আগস্ট মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলি তার যান পায়ের পেছনের অংশে ঢুকে পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। তামিম বলেন, ‘গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। পুরো ডান পা অবশ হয়ে যায়। রক্ত আর রক্ত। হাঁটতে পারছিলাম না সহজে। ওই অবস্থাতেই গুলি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিই রাস্তার ফ্লাইওভারে। আধাঘণ্টা পর গুলি থামলে নেমে আসি। পরে মানুষজন আমাকে হাসপাতালে নেয়।’
সেদিন মিরপুরের একটি হাসপাতাল ঘুরে তার আশ্রয় হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখান থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। কিছুদিন ড্রেসিং করে। কিন্তু আস্তে আস্তে জায়গাটা পচে যায়। তখন পঙ্গু থেকে আমাকে হৃদরোগে পাঠায়। সেখানে টেস্ট করার পর তারা বলে যে, পা রাখা যাবে না। এটা কেটে ফেলতে হবে। পরে পঙ্গুতে আবারও ডাক্তাররা দেখে। তারা বলে যে, পা রাখার আর কোনো সুযোগ নেই।
তামিমের পা কেটে ফেলার পর নতুন জটিলতা শুরু হয়। পা বিহীন অবস্থার সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তামিম। অপারেশনের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু পা হারিয়েও পা থাকার ‘অদ্ভুত’ অনুভূতি এখনো বয়ে চলেছেন অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী।
‘প্রথম তিন-চার দিন আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার মনে হতো যে, পুরো পা আমার অক্ষত আছে। পায়ে যেখানে গুলি লেগেছিল, সেখানকার ব্যথা আমি এখনো অনুভব করি। অথচ সেই পা কেটে ফেলা হয়েছে। মাঝে মাঝে চুলকায়। চুলকাতে গিয়ে দেখি পা নেই।’
তামিম এখন অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন নতুন জীবনে। কিন্তু তার জীবনধারা যে আজীবনের জন্য বদলে গেছে, বুঝতে পারছেন সেটাও। ‘আমি এখন ক্র্যাচে ভর করে হাঁটার চেষ্টা করছি। আমি ফুটবল খেলতাম। সেগুলো মনে পড়ে। আমার বন্ধুরা খেলবে। কিন্তু আমি খেলতে পারব না -এগুলো মনে হয়। তখন আমার আম্মু ডাক্তারদের কথা বলে যে, তারা এমন পা লাগায় দিবে যে তুমি খেলতে পারবে।’
তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক, ভবিষ্যৎ নিয়ে হাল ছাড়ছেন না তামিম। স্বপ্ন দেখছেন, বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবেন।
‘আবু সাঈদ ভাই যখন মারা গেছে। অনেকেই আহত হয়েছে। তখন আমি বসে থাকতে পারিনি। আমার আম্মু নিষেধ করেছিল, কিন্তু আমি শুনিনি। এখন ভাবি, আমি তো নিজেই সাহস করে আন্দোলনে গিয়েছি। নিজের একটা অঙ্গ গিয়েছে, আফসোস নেই। তবু দেশটা যেন ভালো থাকে।’
মেরুদণ্ডে আটকে আছে বুলেট : তামিম থেকে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক গাজীপুরের শাকিলের গল্পে। পেশায় পিকআপ ভ্যানচালক শাকিল আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলি খেয়েছেন। মেরুদণ্ডের হাড়ে আটকে থাকা সেই বুলেট নিয়েই এখন জীবন-মৃত্যুর হিসেব কষছেন তিনি। মো. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘গাজীপুর মাওনার মোড়ে আমরা মিছিলে ছিলাম। সেখানে হঠাৎ করে বিজিবি গুলি ছোড়ে। এর একটা বুলেট এসে লাগে আমার কোমরে। এত জোরে ধাক্কা লাগে যে আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমার ওপর দিয়েই মানুষজন পালাতে থাকে। এত রক্ত বের হয় যে থামানো যাচ্ছিল না।’
সেদিন প্রাথমিক চিকিৎসা নেন গাজীপুরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে। সেখানে এক্স রে রিপোর্টে ধরা পড়ে যে, কোমরে মেরুদণ্ডের হাড়ে বুলেট আটকে আছে। ‘যখন দেখি যে বুলেট, আমি তো আতঙ্কে পড়ে যাই। মেরুদণ্ডের এমন জায়গায় বুলেটটা আটকে আছে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না। তখন সবার আগে আমার বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছিল। আমার কিছু হলে বাচ্চাটা তো এতিম হয়ে যাবে।’
শাকিল পরে চিকিৎসা নেন বিএসএমএমইউতে এবং পরে সিএমএইচএ। কিন্তু সবখানেই জানানো হয়, এই বুলেট ‘বের করা যাবে না’।
‘মেরুদণ্ডে এমনভাবে আটকে আছে বুলেটটা যে এটা বের করতে গেলে আমি মারা যেতে পারি। অথবা পেছনের অংশটা প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে। সব হাসপাতাল এটাই বলছে। যেভাবে আছে সেভাবেই রাখতে হবে আপাতত। আর এটার চিকিৎসা নিতে হলে দেশের বাইরে যেতে হবে। কিন্তু সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার সেই সামর্থ্য নেই।’
শরীরে বুলেট নিয়ে শাকিল ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। গাড়ি চালকের চাকরিও ছেড়েছেন। বলছেন, শুধু নিজের জীবন নয়, বাবা-মা’সহ ৬ সদস্যের সংসারের ভবিষ্যৎও এখন অনিশ্চিত। বুলেটটা তো বের করা যাচ্ছে না। বুলেট নিয়ে আমি কতদিন থাকব? এটা তো বের করতে হবে। কারণ এটা তো একটা লোহা। এটা জং ধরতে পারে। গানপাউডার থাকতে পারে। সেখান থেকে ইনফেকশন হইতে পারে। আজকে না হলেও কিছুদিন পর তো সেটা হইতেই পারে।
আমি গাড়ি চালিয়ে যে টাকা ইনকাম করি, সেটা দিয়েই আমার ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া, বাবা-মা এবং আমার নিজের সংসার চলে। এখন তো আমি প্রায় অচল। কাজ নেই, আয় নেই। আমার সংসারের কী হবে? আমি কি বাঁচতে পারব? শাকিল আহমেদ আশা করছেন, তার উন্নত চিকিৎসার জন্য যেন সবাই এগিয়ে আসে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও তার একই আকুতি।
আমজাদের আলোর জীবন এখন পুরোটাই অন্ধকার : মেরুদণ্ডে গুলি নিয়ে শাকিল তবু বেঁচে আছেন। কিন্তু নোয়াখালীর আমজাদ যেন বেঁচে থেকেও মৃত। কারণ, ছররা গুলি চোখে লেগে হারিয়েছেন দৃষ্টি। হঠাৎ করেই তার আলোর জীবন এখন পুরোটাই অন্ধকার। কিন্তু তার এমন অবস্থা হলো কী করে? পঙ্গু হাসপাতালের কেবিনে বসে কথা হয় আমজাদের সঙ্গে। তিনিও গুলিবিদ্ধ হন গত ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে।
তখন দুপুরের পর। যাত্রাবাড়ীর ছাদ থেকে গুলি করে। আমার পায়ে গুলি লাগার পর মাটিতে পরে যাই। তখন সবাই পালায় যায়। এই সময় দুজন পুলিশ আমার কাছে আসে। আমি অনেক কষ্টে হাত তুলে গুলি না করতে অনুরোধ করি। কিন্তু দশ হাত দূর থেকে ওরা আমার চোখ এবং পিঠে ছররা গুলি মারে।
ছররা গুলি চোখে লাগার কিছুক্ষণ পর থেকেই আমজাদ চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করেন। একপর্যায়ে সব অন্ধকার হয়ে আসে তার চোখে। হারিয়ে ফেলেন চোখের আলো। আর কিছু দেখতে পারছিলাম না। দাঁতে হাত দিয়ে দেখি, গুলিতে দুটি দাঁত ভেঙে গেছে। রক্ত বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। আমজাদ এরপর ভর্তি হন হাসপাতালে। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম হয়ে তার স্থান হয় ঢাকার চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সরকারি খরচে চলে চিকিৎসা।
ডান চোখ থেকে ৫টা গুলি বের করছে। আর বাম চোখ থেকে ৪টা বের করলেও এখনো একটা গুলি রয়েই গেছে। কিন্তু আমি দেখতে পারছি না। আমার আম্মাকে দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পারি না। শুধু তাদের কণ্ঠ শুনে অনুভব করেত পারি। কখন রাত হয়, কখন দিন হয় কিছু বুঝতে পারি না। সব অন্ধকার।
আমজাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে এখনো ছররা গুলির অংশবিশেষ আটকে আছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ নন তিনি।
এখনতো আমার অবস্থা খারাপ। আমার দুই ভাই বড়। কিন্তু তাদের সংসার আছে। আমার ছোটভাই আর মাকে নিয়ে আমি এখন কীভাবে চলব। জানি না ভবিষ্যতে আমার কী হবে! বাংলাদেশে জুলাই এবং আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও এরপরে নিহতের সংখ্যা সাড়ে ছয়শরও বেশি বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘ। আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার।
"