বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি থাকতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি অন্তর্র্বর্তী সরকার ও শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতিসহ দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আশিকুর রহমান শুভ, সঙ্গে ছিলেন মো. জামিন মিয়া। স্বনামধন্য এ গবেষক ও শিক্ষাবিদ বলেছেন, বিরাজনীতিকরণ কোনো সমাধান নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনীতি থাকতে হবে।
প্রশ্ন : ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় গণ-অভ্যুত্থান বলা হচ্ছে। পূর্ববর্তী গণ-আন্দোলনগুলোর সঙ্গে আপনি এই আন্দোলনের কোনো পার্থক্য দেখেন?
ড. হুমায়ুন কবির : ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ব্যতীত এই অঞ্চলে আরো দুটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে যার একটি হয় ১৯৬৯ সালে এবং অপরটি ১৯৯০ সালে। গণসম্পৃক্ততার ভিত্তিতে অবশ্যই ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান অন্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন। আবার আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণে বলা যায় ২৪ এর অভ্যুত্থান বাকি দুটি থেকে ভিন্ন। এই দুটি আন্দোলনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান কোটা সংস্কারের ভিত্তিতে শুরু হয়ে কোনো রকম ইশতেহার বা ঘোষণাপত্র ছাড়া গণমানুষের সম্পৃক্ততায় অভ্যুত্থানটি সফল হয়। যেহেতু পরবর্তীতে এই আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে ছিল না সেহেতু আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাই মনে করেছে তার অভিযোগের জায়গাটাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। ফলে সে নিজেকে আন্দোলনের অংশ মনে করেছে। কাজেই এই অভ্যুত্থান আকারে ও চরিত্রগতভাবে পূর্ববর্তীগুলোর চেয়ে ভিন্ন।
প্রশ্ন : ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই মুহূর্তে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সামনে আপনি কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
ড. হুমায়ুন কবির : প্রথমত, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ গণমানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ। এই অভ্যুত্থানের যেমন দার্শনিক ভিত্তি জনগণের কাছে দুর্বল তেমনি জনপ্রত্যাশাও সুংগঠিত নয়। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ সমর্থক জনসমষ্টিকে এই সরকার কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করবে এটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন তাদের ঐক্য ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ। এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা কীভাবে প্রতিফলিত করা যায় তাও একটি চ্যালেঞ্জ। চতুর্থত, রাজনৈতিক দলগুলো গণঅভ্যুত্থানে সম্পৃক্ততার উদ্দেশ্য হলো দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়া কিন্তু জনপ্রত্যাশা হচ্ছে রাষ্ট্রের সংস্কার। ফলে রাজনৈতিক চাপ সামলিয়ে গণপ্রত্যাশা পূরণ এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে।
প্রশ্ন : নতুন সরকারের মূল লক্ষ্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?
ড. হুমায়ুন কবির : অবশ্যই। আমি মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোর আমূল সংস্কার ছাড়া এ দেশে কখনোই গণতন্ত্র টেকসই হবে না। এ দেশের রাজনীতির অন্যতম বড় সমস্যা রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলে নেতা নির্বাচিত হয় না। প্রধান দলগুলোতে একান্তভাবে পরিবারতন্ত্র বিদ্যমান। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি না হলে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক বর্তমান কাঠামোতে তারা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন : বর্তমান বাস্তবতায় দেশের জনগণকে আকর্ষণ করতে সক্ষম এমন কোন নতুন রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন?
ড. হুমায়ুন কবির : ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নতুন বাংলাদেশ। এখানে ‘টেডিশনাল’ রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। সামরিক শাসন, চারদলীয় জোট সরকারের শাসন, সর্বশেষ চৌদ্দ দলীয় জোটের শাসন মানুষ দেখেছে। এ থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণ করতে হবে। নতুন বাংলাদেশে পুরোনো ধ্যান-ধারণার দল দিয়ে হবে না। এমন রাজনৈতিক দল প্রয়োজন যারা জনআকাঙ্ক্ষা বুঝবে সর্বোপরি এ প্রজন্মের ছাত্রদের মনোভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতির পাশাপাশি ছাত্র-রাজনীতি বন্ধ করার দাবিটি বেশি তোলা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়নটা আসলে কি?
ড. হুমায়ুন কবির : বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি থাকতে হবে। বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া সমস্যার সমাধান নয়। এটি মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা দেওয়ার মতো আত্মঘাতী হবে। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির সংস্কার দরকার। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষকের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা। বর্তমান আরপিও অনুসারেও রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন রাখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু প্রায় সব দল এটি রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পেশাগত রাজনীতি ছাড়া আর সব বন্ধ করা উচিত। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রশ্ন : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. হুমায়ুন কবির : আপনাদের দুজনকেই ধন্যবাদ।
"