লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

  ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

লক্ষ্মীপুরে সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি

তলিয়ে গেছে ২০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি * ক্ষতি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা * বাড়ছে পানিবাহিত রোগবালাই

লক্ষ্মীপুরে চলমান বন্যা পরিস্থিতির এখনো তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। প্রতিদিন কোথাও এক ইঞ্চি, কোথাও আবার দুই ইঞ্চি পানি কমেছে। এতে করে বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। জেলাজুড়ে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এদের কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে যায়নি। চরম দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বসবাস করছে এ জেলার ৫টি উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা। বন্যায় জেলার প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়।

সরেজমিন জানা গেছে, কয়েকদিন থেকে ধীরগতিতে বন্যার পানি কমছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত কোথাও ১ ফুট, কোথাও ২ ফুট পানি কমেছে। তবে রামগতি ও রায়পুর উপজেলার পানি দ্রুত কমেছে। পানি নিষ্কাশনের গেটগুলো খোলা থাকলেও জেলার ছোট বড় খালগুলোয় অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে দখল ও ময়লা-আবর্জনা ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং অপরিকল্পিত ব্রিজ কালভার্ট তৈরির কারণে পানি দ্রুতনিষ্কাশন হচ্ছে না। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে খালের বাঁধ কেটে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদণ্ডউজ-জামান খান জানান, নোয়াখালীর বানের পানি লক্ষ্মীপুরের ভুলুয়া, ডাকাতিয়া নদী, রহমত খালী, ওয়াপদা ও মহেন্দ্র খাল দিয়ে মেঘনা নদীতে চলে যায়। পানি নিষ্কাশনের গেটগুলো খোলা আছে এবং মেঘনা নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে খালে বাঁধ নির্মাণ, খালের পাশে ভবন নির্মাণ, ময়লা আবর্জনা ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে পানি নিষ্কাশনে বাধা হচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ বাঁধ কেটে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আহমেদ কবীর জানান, জেলায় বন্যায় পানিবাহিত রোগ, ডায়রিয়া ও চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত ১৩ দিনে জেলায় ৫টি উপজেলায় ডায়রিয়া, চর্ম রোগ ও সর্পদংশনে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৩১৮ জন। এরমধ্যে শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৭৮৭ জন মানুষ। তার মধ্যে বেশিরভাগ শিশু। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৬৪টি মেডিকেল টিম নিরলসভাবে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জেপি দেওয়ান বলেন, জেলায় বন্যা বর্তমানে ৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে আছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় এখনো ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আছে। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তিনি জানান, বন্যাকবলিত এলাকা এবং আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার এবং শিশু খাদ্য ও গোখাদ্য বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া পানিবন্দিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, স্বেচ্ছাসেবী এবং বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ও এনজিওগুলো পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বন্যার কারণে বিভিন্ন বিভাগের ক্ষতি সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে জানান, ২০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে এবং এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পুকুর-দিঘিসহ ৮ হাজার ৫৬২ টি জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে। প্রাণিসম্পদে অবকাঠামো ও খাদ্য বিনষ্টসহ খামারি-গৃহস্থদের পশুপাখির মৃত্যু হয়েছে। এতে প্রায় ৮ কোটি ৬৫ লাখ ১২ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি জানান, জেলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের ৩২ কিলোমিটার রাস্তা নষ্ট হয়েছে এবং এতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গ্রামীণ জনপদের ২৯ কিলোমিটার সলিং ও কাচা রাস্তা নষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় ৪৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

কুমিল্লায় বন্যায় হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত : জেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কেউ কেউ ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে বন্যায় হাজার হাজার বাড়িঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক বাড়িঘর বসবাসের উপযোগিতা হারিয়েছে। কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতির এরমধ্যে বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে কিছু কিছু এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ঘরে ফিরে যেতে তাদের আরো তিন থেকে পাঁচদিন সময় লেগে যেতে পারে।

বন্যাকবলিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্যসংকট ও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। তারা জানায়, যেখানে দুবেলা আহার জোটানো কষ্টসাধ্য, সেখানে বাড়িঘর ঠিক করার প্রশ্ন আরো পরের বিষয়। বৃদ্ধ আবুবকর বলেন, নদীর কূলে বসবাস করলেও আমার এ বয়সে কখনো এত পানি দেখিনি। একটি জিনিসও ঘর থেকে বের করার সুযোগ পাইনি। পানির স্রোতে ঘর ভেঙে পড়ে মাটিসহ চলে গেছে। ।

স্থানীয় টিপু সুলতান বলেন, বন্যার পানিতে তাদের ঘরবাড়ি একদম শেষ হয়ে গেছে। কোনো মতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে এমন অবস্থাও নেই। মূলত কৃষি ও দিনমজুরের কাজ করেই তাদের পরিবার চলতো। ভিটেমাটি ছাড়া তেমন আর কোন সম্পদও নেই। এদিকে ভয়াবহ বন্যায় কুমিল্লার বুড়িচংয়ের সর্বত্রই এখন একই চিত্র। যেখানে খেয়ে-পরে টিকে থাকাই কষ্টের, সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বানভাসি হাজারো মানুষ।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলার ১৭টি উপজেলায় মধ্যে বন্যায় আক্রান্ত ১৪টি উপজেলায় ঘরবাড়ি হারিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার পরিবার, সবচেযে বেশি বুড়িচং উপজেলার ৪০ হাজার পরিবার ঘর বাড়ি হারিয়েছে। জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা আবেদ আলী বলেন, জেলায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি ছিল। ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন থেকে ৩৯ লাখ নগদ টাকা ও ৮০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কুমিল্লা জেলায় ১ হাজার ৬০০ টন চাল, নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার ম মুশফিকুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close