খুলনা ব্যুরো
খুলনায় ‘চাঁদা’ না দিলেই মামলা
পারিবারিক-ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে * স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে বিএনপি নেতাদের দায়ের করা মামলাগুলোতে নিরীহ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীকে আসামি করা হচ্ছে। প্রথমে দাবি করা হচ্ছে চাঁদা। না দিলে জড়ানো হচ্ছে মামলায়। প্রতিটি মামলার বাদী বিএনপির স্থানীয় নেতারা। তাদের অধিকাংশই আসামিদের চেনেন না বা নাম জানেন না। মামলার এজাহার তৈরি করে দিচ্ছেন মহানগর ও থানা কমিটির দু-একজন নেতা। অধিকাংশ মামলার পেছনে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অন্য ব্যবসায়ীদের মাঝে ভীতি ছড়ানো, চাঁদা দিতে অস্বীকার করা এবং পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও ভূমিকা রাখছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে সব মহলে।
গত সোমবার খুলনার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল গফফার বিশ্বাস একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, দুর্বৃত্তরা তার ম্যানেজারের কাছে ফোন করে পাঁচ লাখ টাকা চাদা দাবি করেছে। এ ঘটনায় তিনি থানায় জিডি করেছেন। যদিও কে বা কারা চাঁদা দাবি করেছে তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি। তবে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন। এ পরিস্থিতির অবসান করতে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার ও নব্য রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধের দাবিও জানান তিনি।
জানা গেছে, গত ৩০ আগস্ট খালিশপুর থানায় দায়ের করা মামলার বাদী মহানগর বিএনপির সদস্য শাহিনুল ইসলাম পাখি। এজাহারে গত ৪ আগস্ট বিকালে খালিশপুর থানা বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর, ড্রয়ার থেকে ১২ হাজার টাকাসহ লাইট, ভ্যান, টিভিসহ বিভিন্ন জিনিস লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়। মামলায় ১৮০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় ৬০/৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় খোদ খালিশপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান আরাফাত গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এস এম আরিফুর রহমান মিঠুকে আসামি করা হয়েছে। একইভাবে শিল্পপতি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফ আতিয়ার রহমান এবং চেম্বারের পরিচালক শাহ আলম তুহিনকেও আসামি করা হয়েছে। দুর্বৃত্তদের চাঁদা না দেওয়ায় একই মামলায় পরিবহন ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন মনাকেও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালিশপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির পদত্যাগী কোষাধ্যক্ষ এস এম আরিফুর রহমান মিঠু খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজকে আওয়ামী লীগ নেতা কাজী আমিনের দখল থেকে মুক্ত করতে সংবাদ সম্মেলন করেন। মূলত তারপর থেকেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এছাড়া ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তার কাছে বিএনপির নামণ্ডপরিচয় ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা চাঁদা দাবি করে। তিনি ওই চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। এসব কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত অফিস ভাঙচুরের মামলায় তাকেই আসামি হতে হয়েছে বলে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। একই সঙ্গে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
অপরদিকে, হ্যামকো গ্রুপের প্যাকেজিং কারখানা নগরীর খালিশপুর চরের হাটে অবস্থিত। কারখানার উচ্ছৃষ্টাংশের ব্যবসা ছিল ১৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোরশেদ আহমেদ মনির নিয়ন্ত্রণে। চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি পেতে ১৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুন্নার স্মরণাপন্ন হতেন তারা। ৫ আগস্টের পর উচ্ছৃষ্টাংশের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর বিএনপির কয়েকটি গ্রুপ। মোটা অঙ্গের চাঁদা দাবিরও ঘটনা ঘটেছে।
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দেশের বাইরে থাকায় তার পক্ষে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, খুলনাসহ সারা দেশের মানুষ হ্যামকো গ্রুপের পরিচালকদের সম্পর্কে জানেন। তারা কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। গত ২০/২৫ দিনে অনেক ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।
শাহ আলম তুহিন বলেন, কখনো রাজনীতি করিনি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জন্য ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। এর চেয়ে বেশি কিছু না।
শরীফ আতিয়ার রহমান বলেন, গত ১৫ বছরে এক ধরনের চাপে ব্যবসা করেছি, এখন আরো পরিস্থিতি আতঙ্কজনক।
পরিবহন ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন মনা বলেন, তিনি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তারপরও বিনা কারণে অহেতুক তাকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
অপরদিকে, খুলনার রূপসা ট্রাফিক মোড় সংলগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্লোরী আর্ট প্রেসসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক জাহিদ হাবিব ও তার বড় ভাই ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হাবিবের কাছে দুর্বৃত্তরা মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। কিন্তু তারা টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাদেরও মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে তাদের বাসভবন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, যারা আওয়ামী লীগ করে এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, এত রক্ত, এত মৃত্যুর পরও রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানি না হয় তার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। খালিশপুর থানায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নামে দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে খালিশপুর থানার ওসি (তদন্ত) আশীষ কুমার মিত্র বলেন, নিরীহ কেউ থাকলে তদন্তে অবশ্যই তার নাম বাদ যাবে।
"