নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ছাত্র আন্দোলনে হতাহত ও নির্যাতনের জের, তরুণদের মানসিক অভিঘাত

রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা আল রাজি (ছদ্মনাম) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার বাসার কাছেই তিনি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আন্দোলনের মধ্যে তিনি দেখেছেন অনেক কিছু। আন্দোলন ও বিজয়ের পরে বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি। রাজি জানান, তার ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। এছাড়া তার মেজাজ উগ্র হয়ে আছে। অল্প কথা শুনলেই বিরক্ত লাগছে। এমন অবস্থায় গত ২১ আগস্ট জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে এখন দিন পার করছেন। জুলাই-আগস্টে দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে হতাহত হয়েছে অনেকে। নিহতদের প্রকৃত পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সেটি হাজার ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলনের মধ্যে হতাহতের ঘটনা, সংঘর্ষ, রক্তপাত প্রত্যক্ষ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হচ্ছে অনেককেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন শিক্ষার্থী। সহিংসতা, গুলি, বোমা তারা কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের অনেক সহপাঠীর হয়েছে অঙ্গহানী, অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সামান্য আহত যারা হয়েছেন, তাদের অনেকেরই এখনো ক্ষত শুকায়নি। এমন পরিস্থিতিতে মনের মধ্যে ক্ষত নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের।

চিকিৎসকদের মতে, সহিংসতার শিকার কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী উভয়েরই নানা ধরনের মানসিক সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ সময়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে। তরুণরা যারা খুব কাছে থেকে হতাহতের ঘটনা দেখেছে তারা অনেকেই মানসিক অভিঘাতে ও সমস্যায় পড়েছেন।

রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের মানসিক সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২১ আগস্ট থেকে চার ব্যক্তি সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিন জনের বয়স ২২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে এবং একজনের বয়স ৫০ বছর। তারা সবাই পুরুষ।

চিকিৎসকরা জানান, সেবা নিতে আসা এ ব্যক্তিদের উগ্র মেজাজ, ঘুমের সমস্যা, ভীতি এবং অস্থিরতা কাজ করছিল। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদেরকে চিকিৎসকের কাছে রেফার করা হয়েছে। অনেকেই জানেন না, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের মতে, আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ‘একিউট স্ট্রেস ডিস-অর্ডার’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ হতে পারে। সহিংসতার ভয়ংকর স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে পারে। সব সময় অনিশ্চয়তা, বিপদাশঙ্কায় তটস্থ থাকতে পারেন। ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা, অমনোযোগিতা, ভুলে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংসতার শিকার সহপাঠী বা আন্দোলনের সহযোদ্ধাকে রক্ষা করতে না পারার হতাশা থেকে অপরাধ বোধ তৈরি হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতার ব্যাপারটি প্রকাশ করতে না পেরে খিটখিটে মেজাজ হতে পারে। অনেকেই অতিরিক্ত উদ্বেগে আক্রান্ত হতে পারেন। সব মিলিয়ে পড়াশোনায় আগের মতো আগ্রহ বা মনোযোগ পেতে কারও কারও সমস্যা হতে পারে।’

তার মতে, অনেকেরই ভয়, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা বোধ, বিচারহীনতা বা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় সৃষ্ট হতাশা, বৈষম্য ও অসহায়ত্বের বোধ থেকে আত্মহত্যার ঝুঁকিও রয়েছে। করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গেই লেখাপড়ার চাপ তৈরি করা উচিত হবে না। বরং পড়ালেখায় মনোযোগ তৈরিতে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে হবে। শিক্ষার্থীকে নিজের চিন্তা-ভাবনা ও যথাযথ আবেগ প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলাসহ সুস্থ বিনোদনের সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া সামাজিক এবং আইনি নিরাপত্তাবোধ নিশ্চিত করতে হবে। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, পিটিএসডিসহ যেকোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে সতর্ক হতে হবে। এছাড়া মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে, তবে বেশি ঘুম নয়। নিতে হবে প্রয়োজন মতো বিশ্রাম। সুষম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে। সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর চর্চা করতে হবে। রুটিনমাফিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত পেলে যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পিটিএসডি। এ রোগের প্রধান কিছু লক্ষণ হচ্ছে, যে ঘটনা বা অভিজ্ঞতা ব্যক্তির মনে আঘাত সৃষ্টি করেছে, তা বারবার ফিরে আসে। ঘটে যাওয়া ট্রমাটিক ঘটনা কখনো বাস্তব স্মৃতি হয়ে, কখনো কল্পনা বা দুঃস্বপ্নের মধ্যে চলে আসে। ব্যক্তি বারবার সেই স্মৃতিতে আতঙ্কিত বোধ করে, মনে করে তার জীবনে আবারও সেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এছাড়া আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে­- ব্যক্তির স্বাভাবিক আবেগের বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক, রাগ বা অস্থিরতা প্রকাশ করা।’ তিনি বলেন, ‘পিটিএসডির কারণে অনেক সময়ই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এর মাঝে অনেকেই কারণ থাকুক বা না থাকুক বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভুগতে পারেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা শুরু করতে পারেন। পিটিএসডি না হলেও আরো কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে।’ আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মানুষ ভয়াবহ ট্রমা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তীব্র মানসিক আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে মনে করেন তিনি। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন আছে বলে জানান তিনি।

অধ্যাপক কামাল চৌধুরী আরো বলেন, ‘যে সব পরিবারের কোনো সদস্য নিহত হয়েছে, সেই পরিবারের সদস্যদের যারা তীব্র অবসাদে ভুগছেন, যেসব শিশু, কিশোর-কিশোরী আহত হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে বা জেল খেটেছে, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতন, হত্যা, গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলো দেখেছে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখতে হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close