রাজশাহী প্রতিনিধি
গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি
বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন রাজশাহীর নগরের ঘোড়ামারা মহল্লার মিয়াপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে। এ বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ঋত্বিক কুমার ঘটকের রাজশাহীর সেই পৈতৃক বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ খবর পেয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা ভিড় করেন বাড়িটিতে। এ সময় বাড়িটির পাশেই থাকা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলচ্চিত্রকর্মীদের কথা কাটাকাটি হয়েছে।
কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে ঠিকাদার দাবি করেছেন। তবে কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, তাদের সাবেক শিক্ষার্থীরা এটা ভেঙে ফেলেছেন। বাড়িটির পুরো ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে ইজারা দেয়। কলেজটি বাড়ি ঘেঁষেই পশ্চিম পাশে রয়েছে। ২০১৯ সালে বাড়িটির একাংশ ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির অভিযোগ উঠেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তখন রাজশাহীসহ সারা দেশে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। পরে ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় রাজশাহী জেলা প্রশাসন।
গতকাল বুধবার দুপুরে ঋত্বিক ঘটকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বাড়ির কোনো চিহ্ন নেই। এলাকাজুড়ে পুরোনো ইটের স্তূপ পড়ে আছে। রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে সেখানে জড়ো হন। কলেজ অধ্যক্ষের কাছে তারা জানতে চান, ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি কারা কীভাবে ভাঙল। এ সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ বলে, তারা জানে না; দুর্বৃত্তরা এটা ভেঙেছে। এ সময় চলচ্চিত্রকর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের কথা কাটাকাটি হয়। সেখানে থাকা শ্রমিকরা গতকালও বাড়ি ভাঙার কাজ করছিলেন। তারা জানান, তারা এখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভাঙার কাজ করছেন।
কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, ৬ আগস্ট অফিস খোলার দিন তারা আসেন। তখন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এখানে আসেন। তারা বলতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর ছবিটা নামিয়ে নিতে। তখন তারা ব্যানারগুলো নামিয়ে ফেলেন। শিক্ষার্থীরা তখন বলেন, এই জায়গাটা ভেঙে ফেলতে হবে। তখন তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এটা কেন ভেঙে ফেলতে হবে?’ পরে সেদিনের মতো শিক্ষার্থীরা চলে যান। পরে সেদিন রাত ৮টায় তিনি ফোনে জানতে পারেন, এ বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে। তখন এসে দেখেন, ছয় থেকে সাতজন শ্রমিক এটা ভাঙছেন। শ্রমিকরা তাকে জানিয়েছেন, কয়েকজন তাদের টাকা দিয়ে এটা ভাঙতে বলেছেন। ছাত্ররা এটা করিয়েছেন। তার ইন্ধনে এটা হয়নি। কারণ এ জায়গাটা তারা হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোর হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, এটা (ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি) সংরক্ষণের এখন তো আর কিছু নেই। এটা আউটডোর হিসেবে এখন কিছু করবেন। তখন সাংবাদিকরা বলতে থাকেন, ‘আপনাদের প্ল্যানেই এটা ভাঙা হয়েছে।’ তখন সেখানে ঠিকাদার শামীম মিয়াকে পাওয়া যায়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ৫ তারিখে এসে দেখি, ছাত্ররা নাকি বাড়িটির সামনে একটি দেয়াল ভেঙে ফেলেছে। তখন কলেজের স্যাররা আমাকে ডেকে এনে বলেন এটা ভেঙে সরিয়ে দিন। তার পর থেকে আমি শ্রমিক নিয়ে এটা ভেঙেছি।’
এরপর জেলা প্রশাসকের কাছে যান চলচ্চিত্রকর্মীরা। জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ তদন্তের জন্য এক সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি)। এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম সাইক বলেন, রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক এই নিবাসের একাংশ ২০১৯ সালে ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এবার তারা পুরোটাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তারা এটা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, জেলা প্রশাসন এটা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে তারা ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে তারা ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ইজারা থেকে অবমুক্ত করে ঋত্বিক ঘটকের নামে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। সেই চিঠিটা মন্ত্রণালয়ে আছে।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, চলচ্চিত্রকর্মীরা ও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে এসেছিলেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) তদন্ত করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। সেটি দেখা হচ্ছে। যারা এই বাড়ি ভাঙায় জড়িত থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা সংরক্ষণের জন্য যা করা প্রয়োজন, তা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করবেন।
"