চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
ঊষর ভূমিতে কম খরচে বাড়বে উৎপাদন
ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করায় বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এ সমস্যা সমাধানে নেওয়া হয়েছে নতুন উদ্যোগ। জমির ভূ-উপরিভাগের অর্থাৎ নদী ও বিভিন্ন জলাধার থেকে পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। বিএমডিএ সূত্র জানায়, সেচকাজে নদীর ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করায় দেশের উত্তরের এ ঊষর ভূমিতে উর্বরতা বাড়বে। আবাদি জমিতে বছরে ফলানো যাবে ২-৩টি ফসল। কমবে উৎপাদন খরচ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫ উপজেলায় সারা বছর জমিতে নিরবচ্ছিন্ন সেচ দিতে ১৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতদিন ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেই ফসল উৎপাদন করা হচ্ছিল বরেন্দ্র এলাকায়। কিন্তু সেই পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে নদী ও বিভিন্ন জলাধার থেকে পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গভীর ও প্রশস্ত করে খনন করা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজে না আসা মরা খালগুলো। সেখান থেকে ৯৮টি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ৯৮টি সেচপাম্প দিয়ে কৃষকের জমি পর্যন্ত সেচের পানি যাবে। খালে পানি আসবে নদীতে থাকা ভাসমান পাম্প স্টেশনের মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় জমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫ উপজেলায় বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য ‘বরেন্দ্র এলাকার খালে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ নামে এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিএমডিএ।
কৃষক জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক ফসলি জমিতে পানি মিলবে বছরজুড়ে, পাশাপাশি সেচ সুবিধা পাবে অনাবাদি জমি। বরেন্দ্র এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে ভূ-উপরিস্থ পানি কম থাকে। অন্যদিকে বর্ষাকালে এ এলাকার নদীগুলোয় পানি থাকে। প্রকল্পের আওতায় নদীর পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচকাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পানি সরবরাহের জন্য উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদীকে। এসব নদী থেকে পানি এনে জলাধারে পানি সংরক্ষণের জন্য ৩৮ কিলোমিটার খাল এবং একটি পুকুর ও দুটি বিল পুনঃখনন করা হচ্ছে। জানা যায়, পানি আনা ও জমিতে সরবরাহের লক্ষ্যে ১৪৮ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। কৃষক জানান, বরেন্দ্র এলাকায় এ প্রকল্প তাদের জন্য আশীর্বাদ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এক ফসলি জমিতে বছরজুড়ে চাষাবাদ হবে। এতে খরচ কমার পাশাপাশি বাড়বে ফসল উৎপাদন। পাশাপাশি কমবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার। প্রকল্পের আওতায় মহানন্দা নদী থেকে পন্টুনের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে বরেন্দ্র এলাকার শুকিয়ে থাকা খালগুলোয় সারা বছর সংরক্ষণ করা হবে। খাল থেকে সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে ছোট ছোট পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতে পারবেন কৃষক। সেক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দেবে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গোমস্তাপুর উপজেলায় পুনর্ভবা নদীর সোনাতলা পাবদামারী খাঁড়ি ৩ কিলোমিটার খনন এবং কোচল বিল ও চূড়ইল বিল এলাকার সোনাতলায় একটি পন্টুন স্থাপন করে ২২টি সোলার এলএলপির মাধ্যমে ২০ কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গণির মোড় ও গোবরাতলা এলাকায় মহানন্দা নদী থেকে ৪০ কিউসেক পানি উত্তোলন এবং ৭ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হবে। এছাড়া নাচোল উপজেলায় পুনর্ভবা নদীর কাজিগ্রাম ও বিজলিপাড়া দিঘি কোচড়া এলাকায় ৬.৫০ কিলোমিটার খাল খনন ও আশপাশের এলাকায় একটি পন্টুন স্থাপন করে ১৬টি সোলার পাম্পের মাধ্যমে ২০ কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে।
শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগর ইউনিয়নের শ্মশানঘাট এলাকার কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ পানির জন্য এখন হাহাকার করে। ফসল চাষাবাদ করতে পারি না পানির অভাবে। ১ বিঘা জমিতে পানি দিতে খরচ হয় ২ হাজার টাকা। তবে আমাদের এলাকায় বিএমডিএর এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে খরচ অনেক কমে আসবে। সেক্ষেত্রে কৃষকদের ১ বিঘা জমিতে চাষাবাদে ৬০০-৭০০ টাকা খরচ হবে। এতে লাভবান হবেন কৃষক।’ একই উপজেলার মর্দনা গ্রামের আম চাষি জিয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ১৫ বিঘা জমিতে আমের বাগান রয়েছে। আমে গুটি আসার পর থেকে অনেক স্প্রে ও সেচের পানি লাগে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের কারণে চলতি বছর বাগানে পানি দিতে পারিনি। ফলে আমের গুটি ঝরে পড়ে ব্যাপকভাবে। প্রচুর পরিমাণে ফলন বিপর্যয় ঘটেছে আমার ও আশপাশের কয়েক হাজার বিঘা আমবাগানে। চলতি বছর সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ ফলন কম হয়েছে পানি সংকটের কারণে।’
গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের এসব উঁচু জমিতে পানির অভাবে একটি ফসল হয়। অন্যান্য সময়ে অনাবাদি পড়ে থাকে জমিগুলো। কিন্তু বিএমডিএর এ প্রকল্পের সুবাদে উঁচু এসব জমিতে পানি পাওয়া যাবে বছরজুড়ে। ফলে সেসব জমিও এখন চাষাবাদের আওতায় আসবে। এ প্রকল্পকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক।’ ষাটোর্ধ্ব মকবুল হোসেন বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়। কারণ মাটির নিচের তোলা পানিতে প্রচুর পরিমাণে লবণাক্ততা থাকে। কিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় খালগুলো খনন করে নদী থেকে আনা পানি ব্যবহার করা হবে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি আটকে তা ব্যবহার করা হবে জমিতে। ফলে এসব পানির ব্যবহারে জমির উর্বরতা নষ্ট হবে না; এমনকি পানির স্তরও নিচে নামবে না।’
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাঁপাইনবাবগঞ্জ রিজিয়নের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আল মামুনুর রশীদ এ বিষয়ে বলেন, ‘১ ইঞ্চি মাটিও যেন পতিত পড়ে না থাকে, সারা বছর যেন কৃষক তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে বরেন্দ্র অঞ্চল ও এর আশপাশের জমিতে কৃষক সারা বছর কম খরচে সেচ পাবেন। এছাড়া যে জমিগুলোয় বছরে মাত্র একটি ফসল উৎপাদিত হতো, ওইসব জমিতে এখন তিনটি ফসল উৎপাদিত হবে। সেচকাজে নদীর পানি ব্যবহার করায় জমির উর্বরতাও বাড়বে দ্বিগুণ।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজ। প্রকল্পের আওতায় ২২৯০ হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৩২০ টন।’
"