অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
তীব্র হচ্ছে ডলার সংকট
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে এক সপ্তাহ ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ পুনঃস্থাপনে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়বে- অনেকে এমন ধারণা করলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং সংযোগ চালুর পর আগের সপ্তাহের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে তিন গুণেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত রেমিট্যান্সের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমনই তথ্য ওঠে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত এ তথ্যে দেখা যায়, জুলাই মাস শেষে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১৯০৯ মিলিয়ন বা ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর মধ্যে গত ২৮ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৪ দিনেই রেমিট্যান্স এসেছে ৩৪২ মিলিয়ন বা ৩৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। শুধু মাসের শেষ দিনেই (৩১ জুলাই) রেমিট্যান্স এসেছে ১২০ মিলিয়ন বা ১২ কোটি ডলার। এর আগে গত ২১ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৮ মিলিয়ন বা ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ আগের সপ্তাহে অর্থাৎ ১৪-২০ জুলাই পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫০ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন বা ৪৫ কোটি ৭ লাখ ডলার। এর আগের সপ্তাহে অর্থাৎ জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (৭-১৩ জুলাই) রেমিট্যান্স এসেছে ৬০৮ দশমিক ১১ মিলিয়ন বা ৬০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। আর মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ ১-৬ জুলাই পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৭০ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন বা ৩৭ কোটি ৫ লাখ ডলার। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মাসের শুরুর দিকে প্রতিদিন গড়ে ৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে এটা ৮ কোটি ও ৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ সপ্তাহে এই রেমিট্যান্স প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ডলারেরও কম এসেছে। আর মাস শেষে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৬৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন বা ১৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। অথচ জুনে রেকর্ড পরিমাণ ২৫৪১ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন বা ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আর মে মাসে এর পরিমাণ ছিল ২২৫৪ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন বা ২২৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।
অর্থবছর শুরুর প্রথম মাসে রেমিট্যান্সের আসার প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কমেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির। প্রতিষ্ঠানটির জুলাই মাসের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে যেখানে রেমিট্যান্স এসেছিল যথাক্রমে ১৩ কোটি ৮৬ লাখ, ১৬ কোটি ৩ লাখ ও ৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলার; সেখানে মাসের শেষ সপ্তাহে এসেছে মাত্র ২ কোটি ২৮ লাখ ডলার। অথচ বরাবরই রেমিট্যান্স আহরণে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
হঠাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানান, কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে চলতি মাসে রেমিট্যান্স কমে গেছে। এর মধ্যে গত ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় রেমিট্যান্স সংগ্রহ বন্ধ ছিল। এরপর সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু হলে রেমিট্যান্স সংগ্রহ শুরু হয়। কিন্তু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা আংশিক চালুর পর ব্যাংক ও এমএফএসের রেমিট্যান্স সংগ্রহ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ব্যাপক কমেছে।
অথচ স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এদিকে আন্দোলন-সহিংসতায় বহু হতাহতের প্রতিবাদে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়েও ক্যাম্পেইন করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ও প্রবাসীরা। বিপরীতে দেশের ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকটে গ্রাহকরা চাহিদামতো টাকা তুলতে না পারায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, সরকার যদি দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে তাহলে রেমিট্যান্স আহরণে বাংলাদেশকে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে হবে।
এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা স্বাভাবিক দিনে ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পেলেও, ইন্টারনেট সংযোগের ধীরগতির কারণে তা ৮০ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। গত ১ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৯৭৮ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকটি সূত্র জানায়, হঠাৎ বিশাল পরিমাণ রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চাপে পড়তে যাচ্ছে সরকার। নানা কৌশলে যেকোনো মূল্যে রেমিট্যান্স বাড়াতে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিচ্ছে তারা।
এ বিষয়ে জানা গেছে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রভাবশালী ডেপুটি গভর্নর ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) বেশি রেটে রেমিট্যান্স আনতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন। গত রবিবার এই নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এমডি জানান, গত এক সপ্তাহ দেশে ইন্টারনেট ছিল না। ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম হয়নি। সারা বিশ্বের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন প্রায় বন্ধ ছিল। তাই রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এজন্য ডলারের রেট বাড়িয়ে দিয়ে আজ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের নির্দেশনার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য ডলারের দর বাড়ানোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। ব্যাংকগুলো যে রেট অফার করেছে সেটা নিয়মের মধ্যেই আছে।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত ৮ মে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর পর ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়। দুই মাসের বেশি সময় ধরে ডলারের দর ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় স্থিতিশীল আছে। দাম বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। কিন্তু ছন্দপতন হয় গত সপ্তাহে। কোটা সংস্কার ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে গত সপ্তাহের ছয় দিনে অন্য সময়ের এক দিনের সমান রেমিট্যান্সও আসেনি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক রেমিট্যান্স কেনার রেট ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা ৭০ পয়সা অফার করছে।
রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রেমিট্যান্স কমে গেছে। তবে এটা যদি দীর্ঘ মেয়াদে কমতে থাকে তাহলে ভয়াবহ বিষয় হবে। কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে অর্থ পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে দেখা যাবে প্রবাসীরা অর্থ পাঠাবে, তার আত্মীয়স্বজন টাকা পাবে, কিন্তু দেশে ডলার আসবে না। যা অর্থনীতির জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।
রেমিট্যান্স না পাঠাতে নেতিবাচক প্রচারণায় কোনো প্রভাব পড়বে কি না- জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যারা এটা করছে তারা ক্ষোভ থেকেই এমনটা করছে। ক্ষোভ কমে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কেন তাদের এই ক্ষোভ, সেটা সরকারকে দেখতে হবে। কারণ দেশ স্থিতিশীল না হলে বিনিয়োগ করার মতো বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না।
এদিকে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহত ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণা করছেন বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান গুজব ও অপপ্রচার বিশ্বাস না করে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। ভেরিফাইড ফেসবুক পোস্টে প্রতিমন্ত্রী লিখেছেন, রেমিট্যান্স না পাঠালে দেশে আসতে দেওয়া হবে না- এমন একটি মিথ্যা তথ্য ও গুজব সোশ্যাল মিডিয়াতে অপপ্রচার হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জনবান্ধব সরকার সবসময় প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে আমাদের সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। সব ধরনের গুজব ও অপপ্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অপপ্রচারকারীদের রুখতে হবে।
উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর গত ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের শাটডাউন ঘোষণার দিন দুপুরে ইন্টারনেট সেবা সীমিত করলেও রাতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ রেখেই ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড সংযোগ চালু হলেও মোবাইল ডেটার ইন্টারনেট ২৮ জুলাই দুপুর পর্যন্ত বন্ধ ছিল। টানা ১০ দিন বন্ধ থাকার পর গত রবিবার বিকেল ৩টার পর মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিমগুলোয় থ্রি-জি ও ফোর-জি নেটওয়ার্ক পরিষেবা চালু হয়।
সংকটে বেড়েছে ডলার রেট; অভিযানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন :
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমায় খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে ডলারের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। নির্ধারিত দরের বেশি ডলার বিক্রি করলেই ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার সংগঠনটির সভাপতি এম এস জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, দেশের সব মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের জন্য মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য বর্তমানে ১১৯ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলো। যদি কোনো মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান এই নির্দেশনা অমান্য করে তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সব সদস্যকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
এদিকে, ডলার বাজার অস্থিরত হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনার করছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগেও ডলার বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযান পরিচালনা করেছিল। সে সময়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালাও করা হয়।
"