অলিউজ্জামান রুবেল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে চুরি
মামলা নিতে অনীহা ওসির
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠ নয়াগোলায় এক রাতেই চার বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটে। গত মাসের শেষ দিকে সংঘটিত ওই চুরির ঘটনায় আলাদা আলাদা অভিযোগ দেওয়া হয় থানায়। কিন্তু চারটি অভিযোগের একটিও মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি পুলিশ। উল্টো অভিযোগকারীদের সঙ্গেই দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। শুধু নয়াগোলার ঘটনাই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় চুরির ঘটনায় মামলা নিচ্ছে না পুলিশ। অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি চুরি ঘটনায় থানায় মামলা না নেওয়ার তথ্য পেয়েছে প্রতিদিনের সংবাদ। গত রবিবার ভোরে শহরের পাঠানপাড়ায় গৃহবধূকে কুপিয়ে জখম করে স্বর্ণালংকার, মোবাইল ও নগদ টাকা চুরির ঘটনার মামলা নিতেও গড়িমসির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঘটনার পর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয় না। একটি সাধারণ অভিযোগ দিতে বলে। সেই অভিযোগের একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মাসের পর মাস ওই অভিযোগের আর তদন্ত হয় না। শেষ পর্যন্ত কোনো তদন্ত ছাড়াই তামাদি হয়ে যায় অভিযোগটি।
গত ২৮ জুন রাতে নয়াগোলার যে চারটি বাড়িতে চুরি হয় তাদের মধ্যে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মোহাম্মদ আলীর বাড়ি। তিনিও ঘটনার পর অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আট দিন পর তার অভিযোগটি তদন্ত ছাড়াই পড়ে আছে। মোহাম্মদ আলী বলেন, তার বাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও নগদ টাকা চুরি হয়। ঘটনার পর তিনি থানায় গিয়েছিলেন মামলা করতে। কিন্তু ওসি তাকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। ওসির পরামর্শমতো লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। তিনি আরো জানান, তার অভিযোগটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সদর থানার এসআই শরিফুল ইসলামকে। পরে একাধিকবার তাকে মোবাইলে কল করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। কিন্তু ওই এসআই ফোনে সাড়া দেননি। এমনকি তদন্তের জন্যও আসেননি। তার অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ডও হয়নি। জানতে চাইলে এসআই শরিফুল বলেন, আমি তদন্ত করে এসেছি। ঘটনার সত্যতা আছে বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন মামলা হলো না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আমার কাজটুকু করেছি মাত্র। মামলা হবে কি না, সেটা ওসি স্যারের এখতিয়ার।
২৮ জুন রাতে নয়াগোলার আরো তিনটি চুরির অভিযোগেরও কোনো সুরাহা হয়নি। ওই অভিযোগ তিনটি দিয়েছিলেন আবু সুফিয়ান, আবু রায়হান ও জাহিদ হোসেন।
এদিকে প্রায় ছয় মাস আগে সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের তাহেরপুর-বালুগ্রাম থেকে আবদুল আহাদ নামে এক ব্যক্তির একটি গরু চুরি হয়। চোরেরা গোয়ালঘর থেকে গরু চুরি করে পিকআপে করে নিয়ে যায়। গত ১৩ জানুয়ারি আবদুল আহাদ থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। তার অভিযোগটিও শেষ পর্যন্ত মামলায় রূপ পায়নি।
আব্দুল আহাদ বলেন, ঘটনার পর পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর অগ্রগতি নেই। আমার অভিযোগটি কী অবস্থায় আছে জানি না। তিনি বলেন, অভিযোগটি মামলা হিসেবে নিলে হয় তো কোনো একটা সুরাহা হতো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন ঘটনা ধামাচাপা দিতেই পুলিশ চুরির মামলা নিতে চায় না। কারণ চুরির মামলা নিলে সেটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির রেকর্ডে নথিভুক্ত হয়। মাসিক আইনশৃঙ্খলা প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয়। তাই কৌশলে পুলিশ চুরির ঘটনা মামলা হিসেবে নিতে চায় না। অভিযোগ গ্রহণ করে তদন্তের নামে তালবাহানা করে।
এসব চুরির ঘটনায় মামলা না নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. মেহেদী হাসান সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেছেন, ‘ওসি হিসেবে তিনি নতুন, সবকিছু বুঝে উঠতে সময় লাগবে।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. নূরুজ্জামান জানান, চুরির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি চাইলে সরাসরি মামলা করতে পারবেন। কিন্তু কেন চুরির ঘটনায় মামলা না নিয়ে শুধু অভিযোগ নেওয়া হয়- তা জানেন না তিনি। ওসির কাছে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের দ্বিতীয় তফসিল অনুযায়ী চুরি একটি জামিন অযোগ্য ও আমলযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪, ১৫৫ ও ১৫৬ ধারার বিধান অনুযায়ী আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ পাওয়ামাত্র থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামলা নিতে ও আসামি আটক করতে বাধ্য।
জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট এম আবদুস সালাম বলেন, কোনো ভুক্তভোগী যদি অপরাধীর পরিচয় শনাক্ত করতে পারেন তাহলে তার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করতে পারবেন। এ ছাড়া যদি অপরাধীকে চিহ্নিত না করা যায় সে ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগটি তদন্ত করে সত্যতা পেলে থানায় মামলা হিসেবে রেকর্ড হবে। ৯০ দিনের মধ্যে চুরির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে হবে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। তিনি আরো বলেন, শুধু কাজ ফাঁকি দিতেই পুলিশ চুরির ঘটনায় অভিযোগগুলো মামলা হিসেবে রেকর্ড করে না। কারণ মামলা রেকর্ড হলে পুলিশকে একসময় মামলাটি নিষ্পত্তি দেখাতে হবে।
"