সাইফুর রহিম শাহীন, কক্সবাজার
কক্সবাজারে ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসের শঙ্কা
জনসাধারণকে সতর্ক করতে জেলা প্রশাসনের মাইকিং * এক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে প্রবল বৃষ্টি, বাড়ছে ঝুঁকি * রোহিঙ্গাদের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও
কক্সবাজারে টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার কারণে ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারে থেমে থেমে মাঝারি ও ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। টানা এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে পাহাড়ধসের আশঙ্কা বেড়েছে, এমনটাই বলছে প্রশাসন। স্থানীয়দের সচেতন ও সতর্ক করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান।
জেলা প্রশাসক বলেন, জেলার বিভিন্ন এলাকায় অতিবৃষ্টি হচ্ছে। ওই সময় পাহাড়ি ঢল ও বন্যার আশঙ্কায় মাইকিং করা হয়েছে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় সচেতন বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও মাইকিং করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমেও মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কক্সবাজার এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ও নিম্নাঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সতর্ক করা হয়েছে। এদিকে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় খাল তীরবর্তী গ্রাম ও ঘরবাড়ি। প্রতি বছরই বর্ষার মৌসুমে পাহাড়ধসের আশঙ্কা থাকে। ফলে সে সময়টায় নিচু জায়গায় বসবাসরত লোকজনের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেককে পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে।
সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে শহরের অন্তত ২০ পয়েন্টে পাহাড়ধস হয়েছে। এতে বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরতদের। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কক্সবাজারে পাহাড়খেকোরা পাহাড় কাটার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে বর্ষা মৌসুমকে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে নামিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের মাটি। শহরের পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, খাঁজামঞ্জিল, লাইটহাউস, কলাতলী এবং বাস টার্মিনালসহ ১০টির বেশি পয়েন্টে চলছে গণহারে পাহাড় কাটা। পাহাড় কেটে সমতল করে বের করা হচ্ছে বসতভিটার জায়গা। নির্মাণ করা হচ্ছে ঘরবাড়িসহ বহুতল ভবন। এতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি বসতবাড়ি। ফলে প্রতি বছর পাহাড়ধসে হতাহতের ঘটনা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহরের বাদশাঘোনা এলাকায় অভিযান পরিচালনাকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরাতে মাইকিংয়ের পাশাপাশি সচেতন করা হচ্ছে। বেশি ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড় দখলবাজদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই প্রচারণা অব্যাহত থাকবে।
উখিয়া বালুখালী এলাকার মোস্তাক আহমেদ ও জয়নাল আবেদীন বলেন, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পশ্চিমপাশে বালুখালী ছরা নামক স্থানে পাহাড়ের মাটি সরে গিয়ে বিশাল একটি গাছ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
১১নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিক বলেন, ভারী বর্ষণে ক্যাম্পে ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। অধিকাংশ ঘরে পানি ঢুকছে। আমাদের কষ্টের শেষ নেই। দমন-পীড়নের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গার অধিকাংশই রয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ শরণার্থী শিবিরে। সেখানে বিভিন্ন পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করেছে রোহিঙ্গারা। এদিকে, বর্ষার শুরুতেই পৃথক পাহাড়ধসে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ জন এবং শহরে ২ জনসহ মোট ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ২০ জুন উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ধসের ঘটনায় দুই বাংলাদেশিসহ ১০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন স্থানীয়। এর মধ্যে একজন থাইংখালী উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শাহ আলমের ছেলে আবদুল করিম (১২)। অন্যজন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার হোসেন আহমেদ। দুজনের বাড়ি ১৪ নম্বর ক্যাম্পের পাশে। বাকিরা সব রোহিঙ্গা। গত ২৮ জুন ভোরে কক্সবাজার শহরের বাদশা ঘোনায় অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে গর্ভবতী স্ত্রীসহ স্বামীর মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন স্থানীয় ওমর ফারুক জামে মসজিদের মুয়াজ্জিম আনোয়ার হোসেন (২৬) ও তার স্ত্রী মাইমুনা আক্তার (২০)। বুধবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ধসের ঘটনায় আরো ১ বাংলাদেশিসহ ২ জন নিহত হয়েছে।
এদিকে গেল মঙ্গলবার রাত থেকে টানা ভারী বৃষ্টিতে উখিয়া-টেকনাফে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি আর পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। ডুবে গেছে ঘরবাড়িসহ মৎস্য ঘের, লবণের গোলা। ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট। অতিরিক্ত পানির কারণে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কিছু কিছু জায়গায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। অনেক গাড়ি গ্রামের ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। এদিকে, কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানান, এই বৃষ্টিপাত আরো কয়েকদিন থাকবে। গত বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সচেতন মহল বলছেন, বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি হলেই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। বাকি সময় নীরব থাকে। পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অবৈধভাবে পাহাড়ে দখল করে অবস্থানকারীদের পানি-বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এতে অবশিষ্ট পাহাড় যেমন রক্ষা পাবে তেমননি মৃত্যুর ঝুঁকিও কমবে। রক্ষা পাবে জীবন পরিবেশ প্রকৃতি।
"