প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গাজার আল-শিফা হাসপাতাল
বন্দুকের মুখে রোগীদের হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করল ইসরায়েল
গাজার সর্ববৃহৎ হাসপাতাল আল-শিফায় বেশ কিছুদিন ধরেই ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী (আইডিএফ)। এমতাবস্থায় সেখানে আশ্রয় নেওয়া শত শত শরণার্থী ও রোগীকে হাসপাতালটি ছাড়তে বাধ্য করছে আইডিএফ। খবর বিবিসি ও আলজাজিরার।
হাসপাতাল কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালে অবস্থানরত সবাইকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। গাজার হাসপাতালগুলোর জেনারেল ডিরেক্টর মোহাম্মদ জাকুত বলেন, আমি ইসরায়েলি বাহিনীর মিথ্যা অভিযোগকে প্রত্যাহার করছি। আমি আপনাদের বলছি যে, আমাদের বন্ধুকের মুখে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
মোহাম্মদ জাকুত জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী সকাল ৮টার দিকে কর্তৃপক্ষকে হাসপাতাল কমপ্লেক্সটি মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে খালি করতে বলেন। হাসপাতালে থাকা ব্যক্তিদের এমন একটি পথ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় যেখানে ‘পুড়ে যাওয়া মরদেহ’ ছড়িয়ে রয়েছিল।
গাজার মিডিয়া অফিসের ডিরেক্টর জেনারেল ইসমাইল আল-থাওয়াবতা জানান, ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ৫০০ আহত রোগীকে বন্দুকের মুখে হাসপাতাল ত্যাগে বাধ্য করেছে।
তিনি আরো বলেন, আল-শিফা হাসপাতালটি এখন পুরোপুরি একটি বন্দি শিবির। এটি একটি জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র, সামরিক ব্যারাক ও গণকবরে পরিণত হয়েছে।
আল-শিফা গাজার সবচেয়ে অত্যাধুনিক হাসপাতাল। এতে চলমান যুদ্ধে প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি লোক গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছিল। আল-শিফায় ছিলেন অনেক নারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের স্বজন। হাসপাতাল ছাড়তে দেওয়ার আগে তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করে ‘দেহ তল্লাশি’ চালায় ইসরায়েলি সেনারা।
হাসপাতাল ছেড়ে আসা প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সাংবাদিক জিহাদ আবু শানাব আলজাজিরাকে জানান, ওই অবস্থায় নারীদের কঠোর ‘জেরার’ সম্মুখীন করা হয়।
তিনি বলেন, অপমানজনকভাবে দেহ তল্লাশি করেছে সেনারা। অনেক নারীকে তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করেছে। এসব মারাত্মক লজ্জাজনক ঘটনা।
জিয়াদ বলেন, হাসপাতালে থাকা অনেক বেসামরিক নাগরিককে দ্বিতীয় তলায় জিম্মি করে রাখা হয়। তাদের খাদ্য বা পানি কিছুই দেওয়া হয়নি এবং চরমভাবে অপমান ও লাঞ্ছনা করা হয়েছে।
এদিকে হামাসের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উত্তর গাজার জাবালিয়ায় দুটি বিস্ফোরণে মোট ৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে গাজায় পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ১২ হাজার ৩০০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে আরো দুই হাজারের বেশি মরদেহ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে জাতিসংঘের একটি যৌথ প্রতিনিধি দল আল-শিফা হাসপাতাল সফরের পর এটিকে একটি ‘ডেথ জোন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলায় এরই মধ্যে হাসপাতালটির বহু সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রতিনিধি দলটি প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিয়ে হাসপাতালটি পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষণ শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সেখানে তারা গোলাগুলির আলামত পেয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালের প্রবেশপথে একটি গণকবর দেখেছে। তাদের বলা হয়েছিল যে, এখানে প্রায় ৮০টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে।
ইসরায়েলের আল-শিফা হাসপাতালটি খালি করার নির্দেশের পরও প্রায় ৩০০ জন আশঙ্কাজনক রোগী সেখানে ভর্তি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই রোগীদের গাজার অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
হাসপাতালটিতে অবস্থানরত খাদের নামের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে জানান, চলাচলে অক্ষম কিছু রোগী এবং খুবই অল্প সংখ্যক চিকিৎসক বর্তমানে আল-শিফায় অবস্থান করছেন।
সাংবাদিক খাদের আরো বলেন, ‘আমরা হাত তুলে সাদা পতাকা দেখিয়েছি। গত রাতে অবস্থা বেশ সংকটময় ছিল। বুলডোজারগুলো হাসপাতালের আঙিনায় বড় বড় গর্ত তৈরি করেছে এবং কয়েকটি ভবন ধসে গেছে।’
এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) আল-শিফা হাসপাতাল খালি করার নির্দেশ প্রদানের অভিযোগটি অস্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয় যে, আমরা রোগীদের কিংবা মেডিকেল টিমদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেইনি। বরং প্রস্তাব করেছি যে, চিকিৎসা সংক্রান্ত যেকোনো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হবে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক হাসপাতালটি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি পাওয়া চিকিৎসক রামেজ রেদওয়ান জানান, আল-শিফার অবস্থা এখন খুবই ‘দুর্বিষহ’। সেখানে নেই কোনো ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক। কিছু রোগীর ক্ষতের অবস্থা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো গুরুতর হচ্ছে।
অন্যদিকে হাসপাতালে হামলার বিষয়টিকে ইসরায়েলি বাহিনী হামাসের বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট অপারেশন’ বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু আইডিএফের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সেখানে উপস্থিতির বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
হামলার শুরুর দিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিজেদের নিরপত্তার কথা ভেবে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। তখন হাজার হাজার মানুষ উপত্যকাটির দক্ষিণাঞ্চলের শহর খান ইউনিসে আশ্রয় নেন। কিন্তু এখন আবার আইডিফের পক্ষ থেকে উক্ত শহরটিও খালি করার কথা বলা হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সংকটে গত এক সপ্তাহে গাজার আল-শিফা হাসপাতালে চার অপরিপক্ব শিশুসহ ৪০ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গত শুক্রবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বিদ্যুৎ সংকটে চিকিৎসা সরঞ্জাম চালাতে না পারায় এর আগের ৪৮ ঘণ্টায় মারা গেছে ২৪ জন। জ্বালানি সংকটের কারণে হাসপাতালের জেনারেটরগুলো চালু রাখা যাচ্ছে না।
আল-শিফা হাসপাতাল নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী অভিযোগ, হাসপাতালের ভবনের নিচে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের গোপন সুড়ঙ্গ রয়েছে। সেখান থেকে হামলা পরিচালনা করছে সংগঠনটি। তবে ইসরায়েলি বাহিনীর এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে হামাস ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে গাজায় জাতিসংঘের ১৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সে হিসাবে সেখানে গড়ে ৭০০ মানুষের জন্য মাত্র একটি গোসলখানা ও ১৫০ মানুষের জন্য মাত্র একটি টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর আর একটি কক্ষও খালি নেই। বাস্তুচ্যুত অনেকেই জায়গা না পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর বাইরের সীমানা প্রাচীরের কাছে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে।
"