বদরুল আলম মজুমদার
কোন পথে হাঁটবে বিএনপি?
বিএনপির বাদ-প্রতিবাদ ও হরতাল-অবরোধের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে আগের অবস্থানে এখনো অনড় বিএনপি। এ অবস্থায় আন্দোলন জোরদারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তেমনটি দেখা যায়নি। চলমান ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি শেষ হচ্ছে আজ সোমবার রাত শেষে। হরতাল-অবরোধের মাঝেও সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবিতে বিএনপি রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত রেখেছে। এ দলটির নেতারা বলছেন, তফসিল ঘোষণার ফলে দেশের রাজনীতি আরো সংঘাতের দিকে যাচ্ছে।
অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও বিএনপি নেতারা এমন আশঙ্কা নাকচ করে দিচ্ছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের কথা। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। পাশাপাশি বিএনপির সমমনা দলের পক্ষ থেকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সামনের দিনে হরতালসহ অহসযোগ আন্দোলনের কথা চিন্তা করছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পথে পুরোধমে এগিয়ে গেলেও বিএনপি এখনো অনিশ্চিত পথেই হাঁটছে। আন্দোলন করে নির্বাচন বন্ধ করার মতো শক্তি দলটি এখনো দেখাতে পারেনি। তাই সামনের দিনে দলটির গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে দলে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ দাবি করে আসছেন বিএনপির নেতারা। তাদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের সক্ষমতা নেই বর্তমান ইসির। সরকারের সঙ্গে মিলে তারা একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা করছে। ফলে রাজনৈতিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে তার দায় ইসিকেই নিতে হবে। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল হলো।
সেজন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনকালীন সরকারের ফয়সালার পর তফসিল ঘোষণা করা। যেখানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাই ঠিক হয়নি।’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করেও কোনো লাভ হবে না দাবি করে বিএনপির এ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘অওয়ামী লীগ জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না, ভোটে বিশ্বাস করে না, রাজনৈতিক দলে বিশ্বাস করে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সংলাপ নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘অতীতেও দেখা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর তা বাতিল হয়েছে। আর কার সঙ্গে আমরা সংলাপ করব? বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষনেতা কারাগারে। বিএনপি মহাসচিব জেলখানায়, মির্জা আব্বাস জেলখানায়, নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে; এ অবস্থায় কার সঙ্গে কীভাবে সংলাপ হবে- এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়।’
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, শনিবার তফসিল ঘোষণার পর বিভিন্ন জেলার শীর্ষনেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সভা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতাদের করণীয় সম্পর্কে নানা দিকনির্দেশনা দেন। এছাড়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গেও সভা করেন দলটির হাইকমান্ড। সেখানে চলমান অবরোধ শেষে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর লাগাতার হরতাল বা অবরোধ পালনের বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
এদিকে আজকের হরতাল শেষে মাঝে এক দিন বিরতি দিয়ে আবারও হরতালের ডাক দিতে পারে বিএনপি। একই কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে আন্দোলনের সঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চ ও জামায়াত। অন্যদিকে দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়া নিয়ে জামায়াত এখনো আনুষ্ঠানিক পতিক্রিয়া জানায়নি। তবে আপিলে নিজেদের আইনজীবী না রেখে দলটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দাবি, বর্তমান সরকারের আমলে কোর্ট-কাচারি সবই সরকারের আজ্ঞাবহ। তাই আইনজীবী রাখলে যা হবে না, রাখলেও একই ফল আসত বলে দলটির নেতারা মনে করছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার পরপরই এর প্রতিবাদে রাজধানীতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করে বিএনপি ও অঙ্গ সহযেগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভ করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ, জামায়াতে ইসলামী, আমার বাংলাদেশ পার্টিও (এবি)। বিক্ষোভ শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে গণতন্ত্রমঞ্চের নেতারা জানান, বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতালের পাশাপাশি অবরোধের কর্মসূচি পালন করবেন তারা।
তফসিল ঘোষণার পর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘গোটা বাংলাদেশের প্রত্যাশা, জনমত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর্যুপরি আহ্বান উপেক্ষা করে নিশিরাতের সরকারের তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের তামাশার তফসিল ঘোষণা করেছে। তা আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশে একটি ভীতিকর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হাসিনামার্কা একতরফা নির্বাচনের এ তথাকথিত তফসিল জনগণ মানে না। এ নীলনকশার নির্বাচনের তফসিলে বাংলাদেশের মাটিতে কোনো নির্বাচন হবে না। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল-বিএনপির পক্ষ থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আবারও হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যে ভয়াবহ অচলাবস্থা ও চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে তার পুরো দায়ভার তাদেরই বহন করতে হবে। এ সংকটের কারণে আওয়ামী মাফিয়া চক্রকে চিরকাল দায়ী থাকতে হবে। জনগণের চলমান অগ্নিগর্ভ আন্দোলন আরো তীব্র, আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। অতি দ্রুতই আওয়ামী নাৎসি সরকারের পতন ঘটবে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পর এ সম্পূর্ণ অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবার বিচার করবে জনগণ।’
রিজভী আরো বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার ভাষণে বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবেন। এ কথা তো ডাহা মিথ্যা, ভণ্ডামিপূর্ণ এবং মেকি। শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন বিশ্বাস করা চোরাবালিতে পড়ার শামিল।’ তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, ড. রেজা কিবরিয়া নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, লেবার পার্টিসহ সমমনা দলগুলো। প্রত্যাখ্যান করেছে জামায়াতে ইসলামী।
"