আহমেদ জামিল, সিলেট
শখের বিমান বাড়ি
অজপাড়াগাঁয়ে প্রায় ৩০ শতক জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল আকৃতির বিমান। চারপাশে গাছগাছালি। সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিমানটিতে ওঠার জন্য রয়েছে দুটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি। রয়েছে দরজা-জানালা। বিমানের চারপাশের খালি জায়গা হবে রানওয়ের মতো। বসানো হবে সিগন্যাল বাতিসহ সব ধরনের সরঞ্জাম। আলোকসজ্জাও থাকবে।
দূর থেকে কিংবা ওপর থেকে পাখির চোখে দেখলে মনে হবে লোকালয়ের ভেতর ছোট্ট একটি বিমানবন্দর, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিমান। বিমানবন্দর, রানওয়ে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও উড়াল দিতে পারবে না এ বিমান। কারণ উড়াল দেওয়ার জন্য নয়, বসবাসের জন্য এ বিমান তৈরি করেছেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী। ইট-পাথর দিয়ে হুবহু বিমানের আদলে তৈরি এ বাড়িটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। এরই মধ্যে এ বাড়িটি ‘বিমান বাড়ি’ নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছে।
কোনো প্রকৌশলী কিংবা নকশাকারী ছাড়াই নিজের একক পরিকল্পনায় বিমান বাড়ি নির্মাণ করছেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার পশ্চিম ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা যুক্তরাজ্য প্রবাসী জসিম উদ্দিন। এরই মধ্যে বিমানের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে রানওয়ে ও বিমানের ডানা নির্মাণের কাজ। আগামী বছরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন জসিম উদ্দিনের বড় ভাই লোকমান উদ্দিন।
জসিম উদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন জসিম উদ্দিন। বছরে দুয়েকবার দেশে আসেন। কখনো মাস দুয়েক পার হওয়ার আগেই নিজভূমে চলে আসেন। যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসা-যাওয়া করতে করতে একসময় তার শখ হয় হুবহু বিমানের আদলে একটি বাড়ি বানানোর। শখ পূরণ করতে উদ্যোগ নেন জসিম উদ্দিন। যৌথ পরিবারে নিজের ভাগের প্রায় ৩০ শতক জমির ওপর বিমানের আদলে বাড়িটি নির্মাণ শুরু করেন তিনি। নিজের পরিকল্পনা ও নকশায় প্রথমদিকে স্টিল দিয়ে বিমান নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু নকশায় ভুল হওয়ায় অর্ধেক কাজ করে ভেঙে দেন বিমানটি। পরে আবার নতুন করে কাজ শুরু করেন। দ্বিতীয়বারের মতো নকশায় ভুল হওয়ায় স্টিল দিয়ে বিমান নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি। পরে ইট-পাথর দিয়ে ঢালাই করে বিমানের কাজ শুরু করেন। তৃতীয় দফায় আর নকশায় কোনো ভুল হয়নি। ইট-পাথর দিয়েই বিমান নির্মাণ কাজ এরই মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ করেছেন জসিম উদ্দিন।
সরেজমিনে বাড়িটি ঘুরে দেখা গেছে, বিমান বাড়ির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিমানের ভেতরে চারটি রুম, একটি রান্নাঘর রয়েছে। বিমানের ওঠার জন্য দুটি সিঁড়ি রয়েছে। দুই পাশে দুটি ডানা নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া দুটি আগমন ও বহির্গমন দরজা এবং দুই পাশে বেশ কিছু জানালা রয়েছে। বিমানের চাকার বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই পিলার। বিমানের পেছনে একটি ট্যাংক থেকে পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিমান বাড়িটির মালিক জসিম উদ্দিন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে নির্মাণাধীন বাড়িটি দেখতে এসেছিলেন।
জসিম উদ্দিনের বড় ভাই লোকমান উদ্দিন জানান, আমার ভাইয়ের ছোটবেলা থেকেই শখ একটি বিমান বানিয়ে বিমানের ভেতরে থাকার। শখের বসেই এই বিমানটি বানাচ্ছেন। নির্মাণকাজ শেষ হতে আরো সময় লাগবে।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে স্টিল দিয়ে বিমান নির্মাণকাজ শুরু করেন জসিম উদ্দিন। কিন্তু নিজের পছন্দ মতো না হওয়ায় অর্ধেক কাজ করে ভেঙে ফেলেন। পরে আবার কাজ শুরু করে নকশা ভুল হওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতোও ভেঙে দেন। এরপর ইট-পাথর দিয়ে বিমান নির্মাণ শুরু করেন। মাঝখানে করোনার সময় কাজ বন্ধ ছিল। পরে আবার শুরু হয়েছে। আগামী বছর পুরো কাজ শেষ হবে।
লোকমান উদ্দিন বলেন, বিমানের ভেতরে চারটি রুম, রান্নাঘর, বাথরুমসহ থাকার সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বিমানের ভেতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকবে। নির্মাণকাজ শেষ হলে বিমানের চারপাশের জায়গা রানওয়ের মতো করা হবে। সিগন্যাল বাতিসহ বিভিন্ন ধরনের আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হবে। পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
বিমানের নকশাকারী জসিম উদ্দিন নিজেই উল্লেখ করে তার লোকমান উদ্দিন বলেন, জসিম খুব মেধাবী ছিল। সে দেশে ঠিকাদারি কাজ করেছে। প্রকৌশলীদের সঙ্গে থেকে সে অনেক বিল্ডিং নির্মাণ করেছে। ১৯৯৫ সালে সে সৌদি আরবে চলে যায়। সেখানেই বিল্ডিং নির্মাণকাজ করে। এরপর দেশে এসে ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যে চলে যায়। বিমান বানাতে সে নিজেই নকশা করেছে। প্রবাস থেকে ভিডিওকলে শ্রমিকদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তাছাড়া দুই থেকে তিন মাস পরপর দেশে এসে সে নিজে দেখে যায় বিমানের নির্মাণকাজ।
তিনি আরো বলেন, জসিম উদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছে। সে দেশে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। বিমান বাড়ির কাজ শেষ হলে হয়তোবা এটিকে পার্কের মতো করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিমান বাড়ি নিয়ে তার কী পরিকল্পনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ সে খুবই শৌখিন। যেকোনো সময় নতুন কোনো শখ হতে পারে। তবে, বিমানবাড়িটি একটি পর্যটন স্পট হিসেবে তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে জসিম উদ্দিনের- এমনটি যোগ করেন তার ভাই লোকমান উদ্দিন।
"