প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
উপকূলে মিধিলির হানা
আমন ও সবজিতে ক্ষতি চাষির চোখে সরষে ফুল
* দ্বিতীয় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেন আমন চাষিরা * জমিতে পানি থাকায় বীজ বুনতে পারেনি অনেক কৃষক * বাগেরহাটে টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ধানের বীজতলা * সাতকানিয়ায় ৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে

গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রোপণের পর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় আমন চারা মাঠে নষ্ট হয়ে যায়। পরে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার চাষিকে বীজ সরবরাহ করা হয়। চাষিরা সেই বীজ দিয়ে আবারও নতুন করে আমনের চাষ শুরু করেন। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে আমনের বেশ ক্ষতি হয়। তার মধ্যে আবার ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারনে দ্বিতীয় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেন আমন চাষিরা।
একদিকে শ্রমিকের মজুরি; অন্যদিকে সার-কীটনাশকের বাড়তি দামে চাষির লাভের গুড়েবালি। তার মধ্যে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষক। শুধু আমন ধানই নয়, ইরির বীজতলা এবং সবজি খেতেরও ক্ষতি হয়েছে। চাষির নতুন ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, ৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে মাত্র। প্রায় একই চিত্র উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার। এছাড়া প্রাণহানির খবরও পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট জেলা উপজেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী জানা গেছে, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলায় উপড়ে যাওয়া গাছে চাপা পড়ে এক বৃদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতা জুলেখা বেগম (৬৫) একই এলাকার মৃত সাত্তার আলী বেপারীর স্ত্রী।
বাগেরহাটে টানা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ধানের বীজতলা। মাঠঘাট ও বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি রয়েছে পানির নিচে। বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে বাগেরহাটে ৬৫ হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে বোরো রোপণ করবেন কৃষক। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৩০ হাজার টন। বাগেরহাটে মূলত নভেম্বরের শুরু থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোরো রোপণের মৌসুম চলে। কচুয়া উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক শেখ রুস্তম আলী বলেন, ১৮ কেজি বীজ ধান প্রস্তুত করেছিলাম চারা দেওয়ার জন্য। যে জমিতে বীজ বুনব, সেখানে এখন প্রায় ২ ফুট পানি।
ভোলার বোরহানউদ্দিনে কাঁচা বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার তিন ইউনিয়নে ১৫টি ঘর সম্পূর্ণ এবং শতাধিক ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে গাছপালা। আহত হয়েছে ৫ জন। বিনষ্ট হয়েছে ৩০ শতাংশ আমন ধান এবং ৯০ শতাংশ শাকসবজি ও ডালজাতীয় ফসল। উপজেলা কৃষি অফিসার গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়। ‘মিধিলি’র আঘাতে ৫ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমির ধান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া শাকসবজি, খেসারি, সরষে ফসলের ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাঁদপুর জেলায় ১৯০ হেক্টর আধাপাকা ও পাকা আমন ধান এবং অন্যান্য ৪২০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী এ প্রতিবেদককে জানান, জেলায় আধাপাকা ও পাকা রোপা আমান ১৯০ হেক্টর, সরষে ১৪০ হেক্টর, আগাম শীতকালীন সবজি ২৭০ হেক্টর ও বীজতলা (ধান) ১০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। জরিপ কার্যক্রম শেষ হলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। পটুয়াখালীর দুমকীতে আমন ধান ও রবি মৌসুমের শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিচু জমির আমন ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। রবি মৌসুমের শাকসবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের বাহেরচরের ৫টি কাঁচা ঘর পড়ে গেছে। দুমকী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, বিদ্যুতের ২টি মেইন খুঁটি ভেঙে গেছে, অন্তত ২০টি হেলে পড়েছে, ৭০ টি লাইন ও ৫২টি মিটার ছিঁড়ে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, প্রায় ১৯৪০ হেক্টর প্রান্তিক এবং ১১৫০ হেক্টর ক্ষুদ্র আমন ও ইরি ধানের ক্ষতি হয়েছে। রবি মৌসুমের শাকসবজি, খেসারি ডাল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ইরি আমন ধান, মৌসুমি সবজি খেত এবং ফলদ, বনজ গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বলেশ্বের নদী, খাল, পুকুর, জলাশয়, ধানখেতে পানি বৃদ্ধি পায়। উপজেলার পাতাকাটা গ্রামের মো. আলামীন নাজির বলেন, তার আমন ধান মাটিতে শুয়ে পড়েছে, মৌসুমি সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। জরিপের চর গ্রামের কৃষক মো. মোতালেব হোসেন বলেন, তার এলাকায় ইরি ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সৃষ্ট দমকা বাতাসে গাছের ঢাল পড়ে সিদরাতুল মুনতাহা আরিয়া (৪) নামে এক শিশু নিহত হয়েছে। শুক্রবার বিকেল ৫টায় উপজেলার ৩নং জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় কাটাবিল এলাকার হাসমত আলী ভূঁইয়া বাড়িতে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহত মুনতানা ওই বাড়ির আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়ার শিশুকন্যা।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ এলাকায়। আমন ধান ও শীতকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মিরসরাই উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির পাকা ও আধাপাকা ধানের ক্ষতি হয়েছে। ৪৪ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ঘরের টিন উড়ে গেছে। উপজেলার মিরসরাই সদর ইউনিয়ন, ইছাখালী, দুর্গাপুর, মায়ানী, ওয়াহেদপুর, জোরারগঞ্জ, সাহেরখালী, ইছাখালীসহ প্রায় ইউনিয়নে কৃষকের আমন ধান জমিতে নুইয়ে পড়েছে। মিরসরাই সদর ইউনিয়নের কৃষক মো. মোস্তফা বলেন, ‘আমার ১০ শতকের বেশি জমির ধান বাতাসের কারণে নুইয়ে পড়েছে। অল্প কয়েকদিন পরই ধান কাটার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে এমন বিপর্যয় আশা করিনি।
মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির আমন ধান নুইয়ে পড়েছে। দুয়েকদিনের মধ্যে কাটার উপযুক্ত পাকা ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর মিরসরাই জোনাল অফিসের ডিজিএম সাইফুল আহমেদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হিমমিশ খেতে হচ্ছে। ১২টি খুঁটি ভেঙে গেছে। ৬টি ট্রান্সফরমান নষ্ট রয়েছে। কবে নাগাদ বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলা মুশকিল।’ নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ২১২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, আংশিক বিধস্ত হয়েছে ৯১৩টি ঘরবাড়ি। শুক্রবার রাতে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো.জাহিদ হাসান খান স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার প্রায় অনেক জমির রোপণকৃত আমন ও ইরি ফসল বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। সবজির খেত ক্ষতির মুখে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় মিধিলি না হলে আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেত। হারামিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের কৃষক মোস্তফা বলেন, এখন আমন ধানে ফুল এসেছে। এ সময়ে অতিবৃষ্টি ও বাতাসে ধানে চিটা ধরে যাবে। হারামিয়া ৮নং ওয়ার্ডের কৃষক জামাল বলেন, আমার দেড় কানি জমির আমন চাষ করেছি। বাতাসে হেলে পড়ে এখন পানির নিচে। এ মৌসুমে ঘরে ধান তেলা যাবে না। আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। আমি ঋণ করে এ চাষ করছি।
"