অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
ঢাকা চেম্বারের সেমিনারে বক্তারা
কোম্পানি আইনের সংস্কার চান ব্যবসায়ীরা
বিদ্যমান কোম্পানি আইনকে পুরোনো ও সময়োপযোগী নয় উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজনে এই আইনের সংস্কার এবং তা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে দেশের ব্যবসায়ী মহল। গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর সংস্কার’বিষয়ক সেমিনারে এ দাবি জানান বক্তারা। সংগঠনটির অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। এতে সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি ব্যরিস্টার মো. সামীর সাত্তার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আইন মন্ত্রণালয় হতে খসড়া কোম্পানি আইনের ওপর বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা নিয়ে কাজ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং দ্রুত তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, কোম্পানি আইনে বেশি মাত্রায় ক্ষমতা আরোপ ও শাস্তি দেওয়া বিধান না থাকা প্রয়োজন, কারণ এতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
তিনি আরো বলেন, আরজেএসসির কার্যক্রমে আরো অটোমেশন আনয়নে বর্তমানে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আশা প্রকাশ করেন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এছাড়াও অটোমেশন কার্যক্রম সম্পন্ন হলে সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে আরজেএসসির শাখা অফিস স্থাপনের কোনো প্রয়োজন হবে না। প্রস্তাবিত কোম্পানি আইনে দেশের এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের কীভাবে আরো বেশি সহযোগিতা করা যায়, তা নিরূপণের ওপর জোরারোপ করেন বাণিজ্য সচিব তাপন কান্তি ঘোষ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের আস্থা বৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যমান কোম্পানি আইনের সংস্কার এবং দ্রুত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। দেশে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি করপোরেট খাতে জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে কোম্পানি আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
দীর্ঘদিনের পুরোনো এ আইনটি বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তশীল বৈশি^ক পরিস্থিতি মোকাবিলা ও বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বাড়াতে যথেষ্ট নয়, এমনটা উল্লেখ করে ডিসিসিআই সভাপতি তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহারের মাধ্যমে অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ানো এবং মেধাসত্ত্ব আইনের ব্যবহার বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। এছাড়াও কোম্পানি আইনটি বৈশি^ক আইনের সঙ্গে মিল রেখে ‘মার্জার’ এবং ‘একুইজেশন’ কে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানান ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। সামির সাত্তার বলেন, কোম্পানি আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে আরজেএসসির সক্ষমতা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এর আগে অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, কোম্পানি আইনে ‘মার্জার’ (একীভূতিকরণ) এবং ‘একুইজেশন’ (অধিগ্রহণ)কে অন্তর্ভুক্তির কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে কোনো কোম্পানির অবলুপ্তির প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই প্রস্তাবিত কোম্পানি আইনে বিষয়টি সহজ করতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা প্রয়োজন। তিনি খসড়া আইনে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর)’ ও ‘মধ্যস্থতা’কে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন এবং সেই সঙ্গে পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি নয়, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে আরো স্বচ্ছতা আনতে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর’ (নিরপেক্ষ পরিচালক) বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান। এছাড়াও সব কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘কোম্পানি সচিব’ নিয়োগ, কাজের পরিধি নির্ণয়, স্বচ্ছতা ও জাবাদিহিতা একান্ত অপরিহার্য বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. আবদুর রহমান খান, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) রেজিস্ট্রার (যুগ্ম সচিব) মো. আবদুস সামাদ আল আজাদ, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হল্টম্যান, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের (আইক্যাব) কাউন্সিল মেম্বার ও সাবেক সভাপতি মো. শাহাদত হোসেন এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাভেদ আখতার অংশগ্রহণ করেন।
মো. শাহাদত হোসেন বলেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সময়মতো বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন, প্রতিষ্ঠান বিলুুপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস, এসএমইদের জন্য সার্বজনীন সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করেন।
মো. আবদুর রহমান খান বলেন, কোম্পানি আইন আধুনিক ও যুগোপযোগী হলে ব্যবসা পরিচালন প্রক্রিয়া আরো সহজতর হবে, তাই আমাদের এ আইন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশোধন আবশ্যক। পাশাপাশি ২-৩ বছর অন্তর অন্তর আইনটির সংস্কার করার বিধান রাখা প্রয়োজন। মো. আবদুস সামাদ আল আজাদ বলেন, আরজেএসসির কার্যক্রমে অটোমেশন বাস্তবায়ন হলে এর কার্যক্রম আরো দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
মার্টিন হল্টম্যান বলেন, আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে বিদ্যমান কোম্পানি আইনটি সংগতিপূর্ণ নয়। ব্যবসায়িক কার্যক্রম ঝুঁকি হ্রাস, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের আনানুষ্ঠানিক খাতের ভূমিকাকে কাঠামোবদ্ধ করার জন্য একটি যুগোপযোগী কোম্পানি আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এ আইনের সংস্কার দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে সম্ভব হলে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের আত্মবিশ্বাস বাড়বে বলে হল্টম্যান অভিমত ব্যক্ত করেন। ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে এডিআর ব্যবহারকে আরো উৎসাহিত করার ওপর জোরারোপ করেন জাভেদ আকতার।
"