রাজশাহী ব্যুরো
রাজশাহীতে জোড়া চিকিৎসক খুন
১৮ দিনেও উদঘাটন হয়নি রহস্য
রাজশাহীতে নগরীতে আনুমানিক তিন ঘণ্টার ব্যবধানে জোড়া চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার ১৮ দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত খুনিদের চিহ্নিত বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ নিয়ে নিহতের পরিবারসহ রাজশাহীতে চিকিৎসকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে রাজশাহীর চিকিৎসকরাই কেন দুর্বৃত্তদের টার্গেট? এর পেছনের কারণ কী? এসব নিছক শুধু হত্যাকাণ্ড, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য!
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক কলহ, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক মতবিরোধের মতো কারণ থাকতে পারে। আবার বিচ্ছিন্ন ঘটনাও হতে পারে।
তদন্তে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, তারা দ্রুতই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সামনে আনতে পারবেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) রাজপাড়া থানার এসআই রাজিবুল ইসলাম বলেন, ডা. কাজেম হত্যার তদন্তে বলার মতো এখনো কিছু তাদের হাতে নেই। সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশনা মোতাবেক তদন্ত কার্যক্রম চলছে। যদিও নিহত ডা. কাজেম আলীর পিতা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গোলাম মর্তুজা মন্টু ভাষ্য, তার ছেলেকে হত্যা করতে ছেলের (কাজেম আলী) স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজন জড়িত থাকতে পারেন। তবে পুলিশ এখনো এই বিষয়ে তার বক্তব্য গ্রহণ করেনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বর্ণালী মোড়ে যে রাতে গত ২৯ অক্টোবর ডা. কাজেম খুন হন, তার তিন ঘণ্টা আগে কাছাকাছি এলাকা চন্দ্রিমা থানার কৃষ্টগঞ্জ বাজার থেকে অস্ত্রের মুখে এরশাদ আলী দুলাল নামের একজন পল্লী চিকিৎসককে তুলে নিয়ে খুন করা হয়। দুই খুনের কিলিং প্যাটার্ন প্রায় এক। দুটি খুনে ব্যবহার করা হয় একই রঙের হাইস মাইক্রোবাস। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, দুটি কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া হত্যাকারীদের শারীরিক বর্ণনাও প্রায় অভিন্ন। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, ডা. কাজেম ও ডা. দুলাল হত্যার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত, যাকে টার্গেট কিলিং হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, নিহত কাজেম আলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ৪২তম ব্যাচে এমবিবিএস পাস করেন। পরে এফসিপিএস (ডারমাটোলোজি) ও ডিডিভিসহ (বিএসএমএমইউ) বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবনে ডা. কাজেম আলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্র শিবিরের সভাপতি ছিলেন। আর কর্ম জীবনে তিনি জামায়াতের একজন বড় দাতা সদস্য। অন্যদিকে ডা. দুলালও স্থানীয়ভাবে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
সবশেষ ডা. কাজেম আলী রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল এবং পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত রোগী দেখতেন। নিহতের আগে তিনি প্রতিদিনের মতো লক্ষ্মীপুর এলাকায় অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেম্বার শেষে বাড়ি ফিরছিলেন।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সংশ্লিষ্ট দুই থানার সূত্র বলছে, পূর্বশত্রুতার জেরে গ্রাম্য হোমিও চিকিৎসক এরশাদ আলী দুুলালকে (৪৫) গত ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার দিকে চন্দ্রিমা থানাধীন তার চেম্বার থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আনুমানিক রাত পৌনে ৯টার দিকে কুপিয়ে হত্যা করে শাহমখদুম থানাধীন সিটিহাট এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়। পরে খবর পেয়ে সেখান থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আর চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজেম আলীকে (৪২) একই রাত পৌনে ১২টার দিকে নিজ বাসা উপশহরে ফেরার পথে বর্ণালী মোড়ে মোটরসাইকেল গতিরোধ করে একদল দুর্বৃত্ত তার বুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. কাজেম ও ডা. দুলাল হত্যার ঘটনা ছাড়াও কাছাকাছি সময়ে রাজশাহীর হরিয়ান বাজার ও নাটোরের লালপুরে একইভাবে আরো দুই ব্যক্তিকে হত্যা চেষ্টা হয়েছে। এই দুটি ঘটনাতেও একই ধরনের মাইক্রোবাস ব্যবহার করা হয়েছে। এ ঘটনার এক দিন পর অর্থাৎ গত ৩০ অক্টোবর রাত সাড়ে ১১টার দিকে মহানগরীর তালাইমারী মোড়ে আমেনা ক্লিনিকে নিজ চেম্বারে মোহাম্মদ রাজু আহমেদ (৪৫) নামের আরেক চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে আহত চিকিৎসক রাজুকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ছাড়া গত ৪ অক্টোবর রাজশাহীর হরিয়ান বাজারের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী শাহীন আলমের দোকানের সামনে একটি নম্বরপ্লেটবিহীন মাইক্রোবাস থেকে নেমে দুই দুর্বৃত্ত দোকানের ভেতরে ঢুকে শাহীনকে কোপায়। এরপর শাহীন মৃত ভেবে ঘটনাস্থল ত্যাগের সময় দুর্বৃত্তরা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে চলে যায়। তবে ভাগ্যক্রমে শাহীন আলম বেঁচে যান। এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি এখনো বলেও জানা গেছে। আর মামলা না করার বিষয়টিও যেন রহস্য ঘেরা।
আর এসব ঘটনায় রাজশাহী মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন নেটিজেনরা। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শহরের নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনা করেন। আর ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান চিকিৎসক নেতারা। শুধু তাই নয়, নগরীর সব প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী দেখাও বন্ধ করেছিলেন চিকিৎসকরা।
হঠাৎ রাজশাহীর চিকিৎসকরাই কেন দুর্বৃত্তদের টার্গেট হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. নওশাদ আলী বলেন, ডাক্তাররা কেন টার্গেট হচ্ছেন এটি সঠিকভাবে বলা মুশকিল। এর বিভিন্ন মোটিভ থাকতে পারে। চিকিৎসকদের কাছে তো সব ধরনের মানুষই আসেন। অনেক সময় সবাইকে সন্তুষ্ট করা যায় না। এতে চিকিৎসকদের ওপর অনেকের অসন্তুষ্টি থেকে যায়। সেখান থেকেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি বলেন, রাজশাহীসহ সারা দেশেই ডাক্তাররা অন্যান্য কমিউনিটির চেয়ে ভালো আছে। কারণ, ডাক্তাররা টাকা-পয়সাও ভালো ইনকাম করছে। এটিও মানুষের একটি ক্ষোভ হতে পারে। আবার কোনো রোগীকে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে সেই রোগী যদি মারা যান, সেখানেও স্বজনদের একটি রাগ বা ক্ষোভ থেকে যেতে পারে। আর রাজনৈতিক ব্যাপার তো রয়েছেই।
রাজশাহী নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দাবি করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নেতা আহমেদ শফি উদ্দীন বলেন, তিন বছর আগে পুরো রাজশাহীকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছিল। সে সময় হত্যাকাণ্ড, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা অনেকাংশেই কমে এসেছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে কেন অবস্থার অবনতি হলো তা অনুসন্ধান হওয়া উচিত।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র ও বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জামিরুল ইসলাম বলেন, দুই চিকিৎসক খুনের ঘটনার তদন্ত চলছে। পুলিশের কয়েকটি টিম এটি নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি, শিগগিরই এই দুই খুনের মোটিভ উদ্ধার এবং খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
আর আরএমপি কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, খুনিদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। চিকিৎসকদের হত্যা রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে কাজ করছে পুলিশ। আরএমপি কমিশনার আরো বলেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আপনারা নির্দ্বিধায়-নির্ভয়ে চলাফেরা করুন, পুলিশ সার্বক্ষণিক আপনাদের সুরক্ষায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে কোনো অস্বস্তিবোধ আছে বলে মনে করি না।
"