মঞ্জুরুল হক, জামালপুর

  ০৪ অক্টোবর, ২০২৩

দীনহীন অবস্থায় জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ

* ৮ বছরেও শেষ হয়নি নির্মাণকাজ * অলস পড়ে আছে ২৬ ভবন * করুণ দশা সঙ্গী করে পাঠ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

জামালপুর শহরের ছোটঘর ও মনিরাজপুর এলাকায় পতিত পড়ে আছে জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ভবনগুলো। হোস্টেল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে গিয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীরা জানান, তারা শুরুতে ক্লাস করেছেন সদর হাসপাতালের টিনের ঘরে, কখনো জীর্ণ ভবনে, কখনো পরিত্যক্ত ভবনে। ব্যবহারিক ক্লাস হয়নি ঠিকঠাক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা নেই, খাওয়া-দাওয়ার ভালো ব্যবস্থা নেই, নেই প্রয়োজনীয় লোকবল। এমনি করুণ দশা সঙ্গে করে পাঠ নিচ্ছেন ভবিষ্যতের চিকিৎসকরা। এরই মধ্যে চিকিৎসক হওয়ার পথে তিনটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়েও গেছেন।

নিজস্ব ভবনের অভাবে বছরের পর বছর ধরে এমন দীনহীন পরিবেশে চলেছে জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান। মেডিকেল কলেজের ২২টি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলেও সেগুলো অকেজো পড়ে আছে। অবশ্য গত জুলাই থেকে নির্মাণাধীন একটি ভবনে পাঠদান কার্যক্রম কোনোভাবে শুরু হয়েছে।

জামালপুর পৌর শহরের ছোটঘর ও মনিরাজপুরে ৩৫ একর জায়গার ওপর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য এরই মধ্যে ২২টি ভবন নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। সেগুলো এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। অনেক ভবন যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এত ভবন ওঠার পরও হাসপাতাল ভবনের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। হাসপাতাল ভবন যে স্থানটিতে ওঠার কথা, সেখানে পানি টলমল করছে। ৫০০ শয্যার হাসপাতাল গড়তে আড়াই মাস আগে গণপূর্ত বিভাগের পক্ষ থেকে একটি প্রকল্প ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের জিজ্ঞাসা, নতুন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের সুবিধা পেতে জামালপুরবাসীকে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে। জানতে চাইলে জামালপুর নাগরিক কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণে জামালপুর এবং এর আশপাশের জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আধুনিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ময়মনসিংহ ও ঢাকায় যেতে হচ্ছে।

‘শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ জামালপুর নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জামালপুর গণপূর্ত বিভাগ। প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালের জুনে শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছিল ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর আরো তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এই সাত বছরের মধ্যে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩৮ শতাংশ বলে গণপূর্ত সূত্র জানিয়েছে। শুরুতে ৭১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরে তা বেড়ে ৯৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে মেডিকেল কলেজটিতে ৩৮০ জন শিক্ষার্থী, ৭৩ জন শিক্ষক আছেন। কোনো কর্মচারী নিয়োগ হয়নি।

প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ২২টি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ইন্টার্ন ডক্টরস ডরমেটরি দুটি, সিঙ্গেল ডক্টরস অ্যাকোমোডেশন দুটি, স্টাফ নার্স ডরমেটরি, ইমার্জেন্সি স্টাফ ডরমেটরি দুটি, টিচিং মর্গ, নার্সিং কলেজ একাডেমিক, নার্সিং কলেজ হোস্টেল, মসজিদ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, বিভিন্ন আকারের পাঁচটি আবাসিক কোয়ার্টার, পরিচালক ও অধ্যক্ষের রেসিডেন্স, লন্ড্রি ভবন ও ব্যায়ামাগারের জন্য নির্মাণাধীন ভবনগুলো অবহেলা ও অযত্নে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব ভবন পড়ে আছে। ভবনের প্রাঙ্গণ ঝোপঝাড়, আবর্জনায় ভরে গেছে। অনেক ভবনের কাচের জানালাও ভেঙে গেছে। নির্মিত সব অবকাঠামো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০১৫ সালে মেডিকেল কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। জামালপুর ২৫০ শয্যার হাসপাতালের পুরোনো কোয়ার্টার ও একটি টিনের ছাউনি দেওয়া ভবনে ক্লাস শুরু হয়। এর পর থেকে ওই হাসপাতালের পুরোনো, জরাজীর্ণ বিভিন্ন ভবনে অস্থায়ীভাবে কলেজের কার্যক্রম চলছে। পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাসের দাবিতে কয়েক বছর টানা মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আট বছরেও পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস তৈরি হয়নি। এতে নানা সমস্যায় আছেন শিক্ষার্থীরা। ভালো শ্রেণিকক্ষ নেই, শিক্ষার্থীদের মিলনায়তন নেই, গ্রন্থাগার নেই, শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই, জনবল নেই, খাওয়া-দাওয়ার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। এভাবেই আট বছর পেরিয়ে গেছে। উপায়ান্তর না দেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ভবনে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন। নির্মাণাধীন একাডেমিক ভবনের তিনটি তলায় গত মে মাস থেকে ক্লাস চলছে।

জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এ এস এম ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, দেশের কোথাও অবকাঠামো নিয়ে মেডিকেল কলেজ শুরু হয়নি। তবে ঠিকই কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এবং খুব ভালোভাবেই চলছে। মেডিকেল কলেজের নবনির্মিত প্রশাসনিক ভবনে দেখা দেওয়া ফাটল মেরামত করা হয়েছে।

জামালপুর গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানায়, ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের (এলওসি) ২৮০ কোটি টাকায় ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ভবন নির্মাণ ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার কথা ছিল। কিন্তু এই ঋণ চুক্তির মধ্যে কয়েকটি শর্ত ছিল। তার মধ্যে প্রধান শর্ত ছিল, নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করবে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সে অনুযায়ী, প্রথম দুই দফায় দরপত্র আহ্বান করা হলে ঠিকাদাররা প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা চায়। যে কারণে প্রক্রিয়াটি বাতিল হয়ে যায়। তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হলেও কেউ অংশ নেননি। চার বছর এভাবে দরপত্র আহ্বানের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। পরে ভারতীয় ঋণ প্রক্রিয়াটি বাতিল হয়ে যায়।

ভারতীয় ঋণের টাকায় হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জামালপুরের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন বলেন, এখন বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) অর্থায়নে ওই হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গণপূর্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২৯ মে জামালপুরের গণপূর্ত বিভাগ হাসপাতাল নির্মাণে ৩৩৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকার নতুন একটি প্রকল্প ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। নতুন এই প্রকল্পে ৫৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

দীর্ঘসূত্রতার কারণে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সুফল পাচ্ছেন না উল্লেখ করে জামালপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অজয় কুমার পাল বলেন, মানুষের কল্যাণের জন্য দ্রুতগতিতে কাজ করতে হবে। অবকাঠামোগুলো যাতে পড়ে না থাকে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close