শুভ দে, মাভাবিপ্রবি
ভূমিজদের প্রথম গ্র্যাজুয়েট

ভূমিজ সম্প্রদায়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট অঞ্জন ভূমিজ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পেছনে রয়েছে দারিদ্র্যের কাছে তার হার না-মানার গল্প। মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় এই ভূমিজ সম্প্রদায়ের বাস। সেখানের ফুলতলা চা বাগানের এলবিনটিলা চা পল্লীতে বেড়ে উঠা অঞ্জনের। পুরো নাম অঞ্জন ভূমিজ। নামের শেষে এই ভূমিজ শব্দটিই পরিচয় দেয় তার সম্প্রদায়ের।
জানা গেছে, জন্মের পর থেকে যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদেরই একজন অঞ্জন। আমাদের সমাজে মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থানের দিক থেকে একপ্রান্তে থাকা অঞ্জন ভূমিজ এখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছেন। অঞ্জন ভূমিজ এখন শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কোচিং ও অনলাইনে পাঠদান করছেন। ছড়াচ্ছেন বিদ্যা ও জ্ঞানের আলো।
বাবা অমৃত ভূমিজ একজন স্থায়ী চা শ্রমিক আর মা রতনমনি ভূমিজ অস্থায়ী চা শ্রমিক। তাদের মাসিক আয় ২০ হাজারেরও কম। তিন ছেলেমেয়ে ও তারা দুজন পাঁচজন নিয়ে তাদের সংসার। অভাব-অনটনের এই সংসারে সবার বড় অঞ্জন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। দেশের মধ্যে ভূমিজদের প্রথম সন্তান হিসেবে তিনিই চা বাগানের গণ্ডি পেরিয়ে পড়ছেন উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে। এরপর ছোটবোন অঞ্জলী পড়ছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে। আরেক ছোটবোন এবার উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে। অঞ্জন ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা কখনো ভাবেননি। পড়ালেখার প্রতি ছোটবেলা থেকে অদম্য ইচ্ছা থাকলে তাকে কী আর পড়ালেখা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে ভীষণ আনন্দিত ছিলেন অঞ্জন। এরপর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলেন। অঞ্জন ভূমিজ এই বিষয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একসময় স্বপ্নের মতো মনে হতো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকার দিনের শেষে আলো দেখছি। খুব ভালো লাগছে।
তিনি আরো বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি- চা বাগানে যারা কাজ করেন সবাই দরিদ্র। শিক্ষিতের হার নেই বললেই চলে। গ্রামের কারোর আর্থিক অবস্থা ভালো না। আর্থিক সংকটের কারণে ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে দ্রুত ঝরে পড়ে। এটা খুব খারাপ লাগে। এখন চা বাগানের অনেককেই পড়ালেখার জন্য উৎসাহিত করি।
বাবা বলতেন, পড়াশোনা করে কী লাভ! চা শ্রমিকের সন্তান চা বাগানেই কলম কাটবি- এসব কথা একসময় কষ্ট দিলেও সেই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবো। গরিব হওয়াটা পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অঞ্জন বলেন, আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করছি। ছুটিতে বেশি করে কাজ করতাম। বাবার সামর্থ্য খুব একটা না থাকায় অনেক দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে। পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে খাসিয়া পুঞ্জিতে দিনমজুরের কাজ করি। এইমাত্র খাবার ডেলিভারি দিয়ে আসলাম। আত্মবিশ্বাসের কারণে প্রতিকূল পরিবেশেও পড়ালেখা থামেনি। ঈদ-পূজাসহ অন্যান্য ছুটিতে পুঞ্জিতে কাজ করে পড়ার খরচ জুগিয়েছি। তিনি আরো বলেন, পুঞ্জিতে সব কাজ করি। করোনা মহামারির সময় ভার্সিটির ফি জোগাড় করতে পুঞ্জির মানুষের পোষা প্রাণিদের খাবার কচু পাহাড় থেকে এনে দিতাম। এতে মজুরির সঙ্গে ৫০ টাকা বেশি পেতাম। মহামারির সময় পুঞ্জিতে সকালে যেতাম সন্ধায় আসতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ কমানোর আশায় ছুটি পেলেই বাড়ি এসে পুঞ্জির কাজে চলে যেতাম। আয় দিয়েই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাচ্ছি। তিনি জানান, বাবা গরু বিক্রি, মহাজন, এনজিও থেকে ঋণ এনে আমাকে টাকা দিতেন। তিনি এই ঋণের বোঝা টেনেছেন। তাকে যেন আর এমন কিছুই না করতে হয় সেজন্য সব সময় কাজ খুঁজি। বাড়িতে গেলেই কারো ধান কেটে দিই, কোদাল দিয়ে মাটি কাটি, ধান রোপণ করি। কাজ না পেলে পুঞ্জিতে চলে যাই। তখন কিছু আয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে রুমে রুমে খাবার ডেলিভারি দিই। প্রতিদিন ৫০-১০০ টাকা পাই।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চা বাগানের সংস্কৃতি আমাকে অনেক বেশি টানে। আমি আমার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য-ইতিহাস সবাইকে জানাতে চাই। স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পেছনেও আছে এক ইতিহাস। টাকা কর্জ করে কোচিংয়ে ভর্তি হয়েও প্রথমবার সুযোগ পাইনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তখন আমার বাবা আমাকে শক্তি জুগিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় আমি স্নাতকে পড়ার সুযোগ পেয়েছি কোটায় প্রথম হয়ে এই মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তিও হয়েছিলাম অনেক স্বপ্ন দেখে। পড়ালেখা শেষ করে একজন প্রকৃত শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। শিক্ষাজীবনে নিজের দরিদ্রতার পরিচয়ে অনেক শিক্ষক আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ পর্যন্ত দিতে চাননি তারা। আমি চেয়েছিলাম নিজে শিক্ষক হয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়াব। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও যখন ভর্তি হতে পারছিলাম না, তখনকার প্রক্টর ড. মো. সিরাজুল ইসলাম স্যার আমাকে ভর্তির অর্থ জোগাড় করে দিয়েছিলেন শিক্ষকদের কাছ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারাও সহায়তা করেছিলেন। এমনকি নিজ বিভাগের ব্যাচমেট বন্ধু-বান্ধবীরা আমার ড্রেস, বই কিনে দিয়েছিল। তাদের অবদান আমার সব সময় মনে থাকবে। এমনকি বর্তমানে চলছি এক বড় ভাইয়ের সহায়তায়। তিনি আমাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার করে টাকা দেন। অন্য একজন বড় ভাইও আমাকে সাহায্য করেন। টিউশনি করে প্রথম প্রথম চললেও যখন তারা জানতে পারলেন আমি ভূমিজ সম্প্রদায়ের, আমার টিউশনিগুলো আর থাকত না। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম তখন। আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই, আমার আর্থিক সামর্থ্য থাকলে ডাটা সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করতে পারতাম। দেখা যাক, বিধাতা আমার কপালে কী লিখেছেন।
উল্লেখ্য, অঞ্জন ভূমিজ শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কোচিং ও অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম করে তাদের পড়ালেখায় অবদান রাখছেন।
"