আজাদ হোসেন, চুয়াডাঙ্গা থেকে
৮৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে কেরু

কেরুজ চিনিকল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার ৮৫ বছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পর ৫২ বছরে এই শিল্পকারখানা থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৮শ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল ২০০৯-১০ মাড়াই মৌসুম থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত এই ১৫ আখ মাড়াই মৌসুমেই লাভের পরিমাণ ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পপ্রতিষ্ঠান সচল রাখতে আখের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই।
চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্য কেরুজ চিনিকল। একসময়ে এশিয়া মহাদেশের ২য় বৃহত্তম ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কেরুজ চিনিকলের রয়েছে সোনালি অতীত। সম্প্রতি মিলটিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কেরুজ ডিস্টিলারী কারখানাতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। ডিস্টিলারী কারখানায় অটোমেশিন স্থাপনসহ প্রায় ১৫০ কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। স্বাধীনতার পর কয়েক মওসুম লোকসান গুনলেও পরবর্তীতে মুনাফা অর্জনের অঙ্কটাও বেশ বড়। গত কয়েক অর্থবছরে মুনাফা অর্জনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ডিস্টিলারী ইউনিটের লাভের টাকায় পুষিয়ে যাচ্ছে সুগার ইউনিটে মোটা অংকের লোকসান। খামারগুলোতে লোকসানের রেকর্ড ভেঙে দেখেছে লাভের মুখ।
১৯৩৮ সালে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ দর্শনায় চিনিশিল্প, ডিস্টিলারী, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বাণিজ্যিক খামারের সমন্বয়ে বৃহৎ এই শিল্প কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাক্সওয়েল নামের এক ইংরেজ নিজ প্রচেষ্টায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামের এলাকায় একটি মদের কারখানা চালু করেন। ১৮৪৭ সালে মি. রবার্ট রাসেল কেরুর সঙ্গে অংশীদারত্বে যুক্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যে মি. রবার্ট রাসেল তার অংশ বিক্রি করে দেন। ১৮৫৭ সালে ভারতের রোজতে সিপাহী বিপ্লবের সময় প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসেবে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী লি. হিসেবে নতুন নামকরণ হয়। রোজতে ব্যবসায় উন্নতি লাভ করায় আসানসোল ও কাটনীতে পৃথক শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালে চিনি কারখানার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ইংল্যান্ডের মেসার্স বেয়ার্স লি. ও গ্লাসগো করপোরেশন। সে সময় বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় ১১ হাজার ৫শ টন। আর ডিস্টিলারী কারখানায় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ফ্রান্সের মেসার্স পিনগ্রিসইটি মোলেট। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১ হাজার টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষে আরো একটি শাখা দর্শনায় স্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর এটি পরিণত হয় শত্রু সম্পত্তিতে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। অদ্যাবধি কেরু এ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লি. নামে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
এখানে চিনি, রেকটিফাইড স্পিরিট, দেশি মদ এবং বিদেশি মানের মদ হিসেবে গোল্ড রিবেন্ড জিন, রোজা রাম, ওল্ডরাম, ফাইন ব্রান্ডি, চেরি ব্রান্ডি, ইম্প্রেরিয়াল হুইস্কি, মলটেড হুইস্কি, অরেন্স ক্রাকাউ, জারিনা ভদকা উৎপাদন হয়ে আসছে। তবে ১৪ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে মলটেড হুইস্কির উৎপাদন।
উপজাত দ্রব্য আখ, চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাড দিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের জৈবসার। কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব জমিতে স্থাপন করেছে জৈব সারকারখানা। প্রায় ২০ বছর ধরে বন্ধ রাখা রয়েছে ওষুধ তৈরির কেরুজ ফার্মাসিউটিক্যালস। এ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৫৬ একর। কারখানা ও কলোনি ১৬৬ দশমিক ১৮ একর জমিতে। ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্র ৫ দশমিক ৩০ একর জমিতে। নিজস্ব সড়কের জমির পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৩৫ একর ও শ্মশান ১ দশমিক ২৭ একর। আকন্দবাড়িয়া জৈব সারকারখানা ২৭৯ দশমিক ৭২ একর। ৯টি বাণিজ্যিক খামারের মধ্যে রয়েছে হিজলগাড়ি, বেগমপুর, ফুরশেদপুর, ঝাঝরি, আড়িয়া, ফুলবাড়ি, ছয়ঘরিয়া, ঘোলদাড়ী ও ডিহিকৃষ্ণপুর।
এ প্রতিষ্ঠানে অফিসার এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৩শ। কৃষি খামারের সংখ্যা ১০টি, ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা মিলগেটে ২টি, রোডভিত্তিক ৩৩টি। দেশব্যাপি দেশি মদ বিক্রয় কেন্দ্র ১৩টি ও ফরেন লিকার বিক্রয় কেন্দ্র ৩টি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে কেরুজ কমপ্লেক্স থেকে সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা দেওয়া হয়েছে এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। চিনি কারখানার সাড়ে ৬৮ কোটি টাকা লোকসান পুষিয়েও ৮০ কোটি টাকা মুনাজা অর্জন হয়েছে কেরুজ কমপ্লেক্সে। যা চিনিকল প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। কেরু এন্ড কোম্পানী একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ঐতিহ্যবাহী এই চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে চিনিকলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে মোট লাভের চারভাগের তিন ভাগ লভ্যাংশই এসেছে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দক্ষ পরিচালনার ফলে।
প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে এ প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্যতম কাঁচামাল আখচাষ বাড়ানো খুবই জরুরি। কেরু এন্ড কোম্পানীতে কর্মরত সবাইকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতার মধ্যদিয়ে কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাহলেই রক্ষা পাবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান কেরু এন্ড কোম্পানী। এ অঞ্চল ফিরে পাবে সোনালি অতীত।
তিনি আরো বলেন, আখচাষ বাড়াতে সরকার নানামুখি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে আখের মূল্য বাড়িয়েছে। যার কারণে ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ আখ মাড়াই মওসুমে কৃষক বেশি দামে আখ বিক্রি করতে পারবেন।
‘প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সামাজিক উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তার মধ্যে রয়েছে ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি হাফিজিয়া মাদরাসা, ১টি মসজিদ। মিলের সুগার সেচ ও রোড ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে মিলজোন এলাকাতে চাষিদের আখ পরিবহনের সুবিধার্থে এলাকার রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ ও মেরামতে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে। শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে একটি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান অপু বলেন, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিএসএফআইসির আওতাধীন চিনিশিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছে। যার প্রমাণ আমরা এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। সরকার চাষিদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে আখের দাম যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এ কারণে চাষিরা আবারও আখের চাষ বাড়াবেন এবং সেই সঙ্গে আখের ফলন বাড়বে। এর ফলে দেশের চিনিশিল্প আবার তার সোনালি অতীত ফিরে পাবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
"