প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, আইন কী বলে

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ বা বিনষ্ট করার অভিযোগে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক এবং জেলা প্রতিনিধি শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর আইনের এই বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে মামলা হলেও এ বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয় বা এর তেমন কোনো আইনগত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোর কোনো নিষ্পত্তি হয় না। তাদের মতে, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টির আইনি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকার কারণে এটি আসলে বিভিন্ন সময় হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছেন, অনেক সময় হয়রানির উদ্দেশে কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীনে মামলার শিকার হয়ে থাকেন। তবে সরকার এই অভিযোগে কোনো মামলা গ্রহণ করলে সেটি হয়রানিমূলক নয় বলেও জানান মন্ত্রী।
প্রথম আলোর সম্পাদক, পত্রিকাটির সাভারে নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী একজন ক্যামেরা পারসন এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে। মামলাটির এজাহারে উল্লেখ করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনষ্টের হীন উদ্দেশ্যে’ অনলাইন মাধ্যমে অপপ্রচার করেছেন।
কী আছে আইনে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ২৫ ধারার এক উপধারার (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে।’
তবে এই আইনে যেসব বিষয়ের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি নেই। অর্থাৎ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বলতে কী বোঝোনো হয় বা কী কী কাজ করলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
এর আগে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল সংসদে উত্থাপনের পর মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে এই আইন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিল, ‘নতুন আইনটি অনেক নতুন অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছে, নিশ্চিতভাবে যেগুলো সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।’
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এর আগের ১১ মাসে প্রতি মাসে অন্তত ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে এবং প্রতি মাসে অন্তত ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের ব্যাখ্যা : বাংলাদেশে শুধুমাত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। দেশে প্রচলিত আর কোনো আইনে এর উল্লেখ নেই বলে জানান আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, বড়দাগে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার বিষয়টি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো আজ থেকে ১০০ বা ১৫০ বছর আগে। পরে এই বিষয়টির ব্যাপক অপব্যবহার শুরু হলে সব দেশের আইন থেকেই এই শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে আমাদের দেশের কোনো আইনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি ছিল না বলেও জানান তিনি।
‘এটি এখন আমাদের আইনে এসেছে এবং ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে’, বলেন তিনি।
শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি নেই। তার মতে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি আইনটি হলো মানহানির আইন। তবে এটির সঙ্গেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টিকে সরাসরি জড়িত করা যায় না। কারণ মানহানির আইন অনুযায়ী, কোনো পাবলিক পারসন বা নির্বাচিত ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য সমালোচনা করলে সেটা মানহানি হতো না। তবে বর্তমানে এই বিষয়গুলোও এখন মানহানির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। আর এ কারণেই এই আইনের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ সময়েই এগুলো হয়রানিমূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
একই ধরনের মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মতো শব্দগুলোর ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্ট না করাটা যেকোনো আইনেই খুব বিপজ্জনক। কারণ এ আইন তখন অপব্যবহারের একটা সুযোগ তৈরি হয়।
আইনের ক্ষেত্রে যেকোনো শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা খুবই সুনির্দিষ্ট হওয়াটা জরুরি। তা না হলে আইনটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেটির সংশোধনের দরকার হয়। তার মতে, কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছের ব্যাখ্যা না থাকলে সেটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থার হাতে বড় ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মতোই কাজ করে। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এমন অনেক বিচার বা মামলা পাকিস্তান আমল থেকে রয়েছে। যখন একটি মিথ্যা সংবাদ যা দেশের সুনামের ওপর প্রভাব ফেলে তখনই এটার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এটাকেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথা বলা হচ্ছে।
‘দেশের সম্পর্কে যে তথ্য সত্য নয়, এ রকম একটা খবর প্রকাশ করে দেশকে হেয় করা হয়, মানে হচ্ছে সারা পৃথিবীতে বা জনগণের কাছে দেশটার যা পজিশন (অবস্থান) তার থেকে যদি আরো নিচের দিকে দেখানো হয়।’
উদাহরণ হিসেবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ধরেন, একটা দেশ গরিব না। তাকে বলা হলো গরিব বা দুর্দশাপূর্ণ- এই মিথ্যা তথ্যে এই খবরটা দেওয়াকেই দেশকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয় এবং সেটাই বলছি যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’
ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে হয়রানিমূলক মামলা হয় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, অনেক ব্যক্তি হয়তো হয়রানিমূলক মামলায় পড়তে পারেন। তবে এই মামলাগুলো শুধু হয়রানিমূলক হয় বললে সেটা ঠিক হবে না, আবার হয়রানিমূলক নয়, সেটা বলাটাও ঠিক হবে না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দেখা গেছে, সরকার যখন এসব ব্যাপারে মামলা গ্রহণ করে তখন সেগুলো হয়রানিমূলক হয় না, বলেন তিনি।
বিচার কতটা হয়? বাংলাদেশের একটি থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১৫০০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। এই দুটি মামলার মধ্যে একটি আনা হয়েছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে দুটি মামলাতেই অভিযুক্তদের খালাস দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ। আর তাদের পরই রয়েছে সাংবাদিক। আর যারা এসব মামলা দায়ের করেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে মূল ক্ষতিগ্রস্ত নন। এদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে যে মামলাগুলো হয়, এখনো পর্যন্ত এমন কোনো মামলার বিচার শেষ হওয়ার নজির নেই। বরং এসব মামলা নিম্ন আদালতের গণ্ডি কখনোই পেরোয় না। শুনানি পর্যন্তই এগুলো আটকে থাকে বলে জানান সাবেক বিচার প্রতি আবদুল মতিন।
‘ফাইল (মামলা) হচ্ছে শুনি, কিন্তু ডিসপোজাল (নিষ্পত্তি) হচ্ছে বলে জানি না।’ তিনি বলেন, ‘এগুলো পড়ে থাকছে, অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।’
সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অবশ্যই জরুরি। কিন্তু বাক স্বাধীনতার বিষয়টিও মাথায় রেখে একটা সমীকরণ রাখতে হবে যে, কী করলে সেটা ভাবমূর্তি নষ্টের দিকে যাবে না। এটা সামঞ্জস্য করার জন্যই আইন তৈরি করা হয়।
কিন্তু এই আইন যখন অপব্যবহার করা হয়, তখন মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয় কিন্তু রাষ্ট্রে নাগরিকদের এটি সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত মৌলিক অধিকার। আর মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তা পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বলে মনে করেন সাবেক এই বিচারপতি।
"