আলী আজীম, মোংলা (বাগেরহাট)

  ২২ মার্চ, ২০২৩

সুন্দরবন ধ্বংসের পেছনে বনরক্ষী

মাঘী পূর্ণিমার দুই দিন পর, বিকেল সোয়া ২টা হবে। সুন্দরবনের কটকার খালের পূর্ব দিকে দুটি ছোট মাছ ধরা নৌকা। নৌকা দুটির দিকে এগোতে চোখে পড়ে আরো চারটি নৌকা। এরই মধ্যে সরু খালের মুখে একটি নৌকা দেখা গেল। কাছে যেতেই নৌকা নিয়ে সাগরমোহনার দিকে ছুটতে থাকেন কয়েকজন জেলে। কী করছিলেন বা কী মাছ পেলেন- এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে গেলেন তারা।

মূলত সুন্দরবনের এ এলাকা অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে মাছ ও সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ করা নিষিদ্ধ। ওই দিন রাতে জোয়ার শুরুর আগে কটকা খাল দিয়ে বনের শেলা নদীর দিকে এগোতেই আবারও কয়েকটি জায়গায় দেখা গেল জেলেদের। অভয়ারণ্য এলাকায় অন্তত ৯টি স্থান দেখা গেল চরপাতাজাল পাততে।

পূর্ণিমায় মাছ বেশি পাওয়া যায় জানিয়ে বনের ভেতরের নদী ও খালে আড়াআড়ি জাল ফেলে মাছ ধরা হয় বলে জানালেন তিনটি পর্যটক বোটের তিনজন মাস্টার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, পরিচয় প্রকাশিত হলে তারা সুন্দরবনে কাজ হারাবেন, তাদের কোম্পানিও বিপদে পড়বে। তবে বন বিভাগকে টাকা দিলে অবাধে অভয়ারণ্যেই মাছ ধরা যায়।

অভয়ারণ্য এলাকায় মাছ শিকারের পাশাপাশি গোপনে পাখিও শিকার হয় বলে অভিযোগ আছে। সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ কী করছে, সে প্রশ্নও করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের সুপতি খালে জেলের একটি নৌকায় দেখা মেলে পাখি শিকারের দৃশ্য। ‘বড় কুবো’ একটি পাখি ধরে তার পায়ে দড়ি বেঁধে অন্য পাখি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন এক তরুণ। নৌকার অন্য জেলারা তখন মাছ ধরছিলেন। পরে সেখান থেকে পাখিটি উদ্ধার করে বনের সুপতি স্টেশনে অবমুক্ত করা হয়।

বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৯ দশমিক ৪৯৬ হেক্টর এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর ২১ বছর পর ২০১৭ সালে আরো ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ দশমিক ৫৮৪ হেক্টর এলাকাকে নতুন করে অভয়ারণ্যভুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টরে।

সুন্দরবনের রামপালের পেড়িখালীর জেলে আহম্মদ হোসেন বলেন, নিষিদ্ধ এলাকা বাড়িয়ে লাভ হলো কী? সেখানে আগের মতোই মাছ শিকার চলছে। অবশ্য এতে লাভ হচ্ছে বন বিভাগের আর নেতাদের।

অভয়ারণ্য এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে ৯১ হাজার ৬৯৩ দশমিক ৯৬২ হেক্টর এলাকা, যার অন্যতম কটকা। ১৯৯৬ সালে বনের এই এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনের আয়তনের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি এখন অভয়ারণ্যভুক্ত উল্লেখ করে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের সদর সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. শহিদুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, সুন্দরবনের অভয়ারণ্য থেকে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ। এতে বনের ওপর মানুষের চাপ অনেকটা কমেছে। ফলে বন্য প্রাণী, জলজ প্রাণী, গাছপালাসহ সব ধরনের বনজ সম্পদ বৃদ্ধি পাবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যখন অভয়ারণ্য কম ছিল, তখন জেলেরা বেশির ভাগ জায়গায় নিয়মিত মাছ ধরতে যেতে পারতেন। এখন অভয়ারণ্য বাড়াতে তাদের জায়গা কমে গেছে। ফলে অবৈধ লেনদেন করে সেখানে মাছ ধরতে যেতে হচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।

পাখি গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনে মূল সমস্যা হলো জেলেদের অপরিকল্পিত মাছ ধরা। চারপাশ জাল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরার সময় পাখিগুলোর বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষায় নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু তা সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে কটকাণ্ডকচিখালীতে দেখা যেত দু-একটি দল মাছ ধরত। তারা মৎস্যজীবী ছিলেন। কিন্তু এখন সেখানে দাদনদাতা হয়ে গেছেন কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের সুন্দরবনের প্রতি কোনো মমতা নেই। ফলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছেই।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে মুঠোফোনে বলেন, চলমান সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে ইকোলজিক্যাল মনিটরিং, বনের ওপর গবেষণা কার্যক্রম, অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ করা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, সুন্দরবনকে শুধু রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য চিন্তা করলে হবে না। দীর্ঘ চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হলে সুন্দরবন সুরক্ষা কঠিন। সবার আগে বনের ওপর মানুষের চাপ কমাতে হবে। এ জন্য বনের ওপর নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ইকোট্যুরিজমের কথা বললেও আমাদের পর্যটকরাও কিন্তু বনের ক্ষতি করছেন। ট্যুর অপারেটররাও সবাই সেখানে বন সুরক্ষার বিষয়ে যত্নবান নন। এসব বিষয়ে আরো যত্নশীল না হলে সুন্দরবনেরই ক্ষতি।

বাপার মোংলার আহ্বায়ক নূর আলম শেখ বলেন, সুন্দরবনকে কোনোভাবেই একটা রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। এ বন আমাদের বাংলাদেশের ফুসফুস। এই মূল্য তো রাজস্বের বিচারে করলে হবে না। এই বন থেকে দেখা যাবে সরকার সব মিলিয়ে বছরে ১০ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। কিন্তু এখানে টাকাটা মুখ্য বিষয় নয়। বনটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার, টিকিয়ে রাখা দরকার। রাজস্ব আয় করত গিয়ে যদি বনের ক্ষতি হয়, প্লাস্টিক দূষণ হয়, বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিষ দিয়ে মাছ শিকার হয়- এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজস্ব না এলেও আমাদের প্রয়োজনেই বনটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close