জাহিদুল ইসলাম

  ২২ মার্চ, ২০২৩

অর্থনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত

দেশের ব্যাংকিং খাত মোটামুটি নিরাপদ

রেমিট্যান্স কিছুটা হ্রাস পেলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ব্যাংক যেসব কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছে সে ধরনের কোনো কারণ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে নেই। তাই দেশের ব্যাংকিং খাতকে মোটামুটি নিরাপদ বলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তবে দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় সুশাসন ঘাটতি ও নীতি-সহায়তা নিয়ে সমালোচনা করেছেন তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রা) বড় বিনিয়োগ, স্টার্টআপের মতো ছোট উদ্যোগে বড় বিনিয়োগ, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ ও গৃহায়ন খাতে বড় বিনিয়োগ। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক হয়ে ব্যাংকগুলোতে তদারকি বৃদ্ধি করলেও যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে তা এ দেশে অনুপস্থিত বলছেন তারা। তবে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলে তারা মত দেন। তা ছাড়া ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালকদের মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বাড়ার অন্যতম কারণ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ না হলেও আমাদের দেশে তা নিষিদ্ধ। ফলে এই ঝুঁকি থেকে দেশের ব্যাংকগুলো নিরাপদ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি করেনি। তারা ধীরে ধীরে নীতি সুদের হার সামান্য বাড়িয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ও মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করেছে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি পড়েনি। এমনকি নির্দিষ্ট কোনো খাতে দেশের ব্যাংকগুলোর একতরফা বিনিয়োগও নেই, ফলে মন্দার কারণে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কামুক্ত।

এদিকে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। ফলে সংকট মুহূর্তে এটাকে আশার আলো হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছরের মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে রিজার্ভ সবচেয়ে হ্রাস পেয়েছে। এ সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২.২২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে তা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৩২.২৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে বেড়েছে প্রবাসী রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাত্রা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেমিট্যান্স খাতে এসেছে ১৪.০১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৩.৪৪ বিলিয়ন ডলার। এ েেক্ষত্রে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৭৪.৮৬ মিলিয়ন ডলার কম এসেছে। রেমিট্যান্স কিছুটা হ্রাস পেলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসেছে ৩৭.০৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ছিল ৩৩.৮৪ বিলিয়ন ডলার। তবে রপ্তানি আয় বাড়লেও এ সময় পর্যন্ত রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার থেকে ১৬৬.৩২ মিলিয়ন ডলার পিছিয়ে আছে।

মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া ও হিসাব পদ্ধতিতে কারসাজিকে এই খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সংকট যত বড়ই হোক সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কোনো ব্যাংকই বন্ধ হতে দেয় না দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরং নীতি-সহায়তা দিয়ে সচল রাখে। এতে নির্দিষ্ট কিছু লোক উপকৃত হলেও জনসাধারণের বড় একটি অংশ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকগুলোকে ভালো রাখতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, বড় অঙ্কের ঋণের তদারকি বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের বিভিন্ন সূচকগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা বা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের চেয়ে এই পরিমাণ কিছুটা কম। সম্প্রতি সংসদে সর্বোচ্চ ২০ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তাদের সম্মিলিত ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

এভাবে একক গ্রুপ বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের আমানত। নিয়মিত আদায় করা যাচ্ছে না, ফলে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। কোনো বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হলে এক ধাক্কায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে যে সংকট তৈরি হয় তা উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওই ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনমতো অর্থের জোগান দিয়ে কৃত্রিমভাবে সচল রাখছে।

বাংলাদেশে নীতি-সহায়তা দিয়ে এর আগে একাধিক ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো সফলভাবে এখন পরিচালিত হচ্ছে না বলে অভিযোগও আছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল করে স্বাস্থ্য ভালো দেখানো হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসন ও হিসাব পদ্ধতির দিক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি রয়েছে। রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা শুধু নীতি প্রণয়ন করে, আর সেই নীতি বাস্তবায়ন করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণ ও আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি ঋণ অনুমোদনও করে পরিচালকরা। বড় অঙ্কের ঋণগুলো তাদের মাধ্যমে পাস হয়। নবায়নের প্রস্তাবও অনুমোদন করে তারা। কিন্তু সেই ঋণ যখন খেলাপি হয় তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close