চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি

  ১৮ মার্চ, ২০২৩

দুই ভাইয়ের মাদক সিন্ডিকেট

চারঘাটের আতঙ্ক আরিফ-আগুন

সীমান্তবর্তী রাজশাহীর চারঘাট উপজেলাজুড়ে আতঙ্কের নাম ‘আরিফ-আগুন’। মাদক কারবার, ছিনতাই, অপহরণসহ সব অপরাধেই এই দুই সহোদরের রাজত্ব। চারঘাট মডেল থানার শীর্ষ ১০ মাদক কারবারির তালিকায় রয়েছে এই দুই ভাইয়ের নাম। গত দুই বছরে দুই ভাইয়ের নামে ৯টি মামলা করা হয়েছে। একের পর অপরাধে জড়ালেও থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের ভয়ে জেলেরাও নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারছেন না। পদ্মা নদীর ভারতীয় খাসমহাল চরে অবস্থান করে নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক সাম্রাজ্য।

জানা যায়, উপজেলার ইউসুফপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য শরীফুল ইসলামের দুই ছেলে আরিফ (৩০) ও আগুন (২৬)। পদ্মা নদীর তীরে বাড়ি হওয়ায় ছোট থেকেই মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কাজে নদীতে অবাধে চলাফেরা করত তারা। কিশোর বয়সেই স্থানীয় মাদক কারবারি পাঞ্জাতন আলীর মাদক আনা-নেওয়ার কাজে জড়িয়ে পড়ে দুই ভাই। মাদক আনা-নেওয়া করতে গিয়ে ভারতীয় ও বাংলাদেশি বিভিন্ন মাদক কারবারির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে, একপর্যায়ে নিজেরাই হয়ে যায় মাদকের জোগানদাতা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউপি নির্বাচনে আরিফ ও আগুন বিপুল টাকা খরচ করে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে বাবা শরীফুল ইসলামকে ইউপি সদস্য নির্বাচিত করে। এতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সখ্যতা আরো গভীর হয়। বাবার ইউপি সদস্য পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলে মাদক সাম্রাজ্য। বর্তমানে মাদক কারবার, ছিনতাই, অপহরণসহ তাদের বিভিন্ন অপরাধে কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছেন।

থানা সূত্রে জানা যায়, আরিফের নামে ছয়টি মাদক ও একটি মারধরসহ মোট সাতটি মামলা রয়েছে। চারঘাট মডেল থানায় মামলাগুলো করা হয়। এদিকে ছোট ভাই আগুনের নামে চারটি মাদক ও তিনটি মারধরের মামলা রয়েছে। আরিফ ও আগুন সর্বশেষ আটক হয় গত বছরের ১৭ মে। মাস খানেক জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসে, এরপর থেকে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আরিফ ও আগুন প্রথম আলোচনায় আসে গত বছরের জুলাইয়ে। আরিফের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে আরিফকে বলতে দেখা যায়, ‘আমার জীবনে আর কিছু নাই, হয় এসপার নয়তো ওসপার। প্রতিদিন দুই-তিন হাজার মাল (ফেনসিডিল) তুলছি। কাছে সব সময়ই ১০-২০ লাখ টাকা থাকছে। এর চেয়ে আর কী পাওয়ার আছে। আমার কিছু হলে আমার বাপ শরীফ, ভাই আগুন আছে। তারা পরিবারকে দেখবে।’

গত নভেম্বরে মাদক কারবারি অন্য গ্রুপের সঙ্গে আরিফ-আগুনের একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষ মাদক কারবারি হৃদয়ের বাড়ি থেকে গরু-ছাগল এনে নিজ সমর্থকদের নিয়ে ভোজের আয়োজন করে।

স্থানীয় মাদক কারবারি আশিক আলী বলেন, আরিফ-আগুনের সঙ্গে আমাদের কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। তাদের কারণে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা আমরাই এলাকা ছাড়া হয়ে গেছি। গোলাগুলির বিষয়টি জানাজানি হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে দুই ভাই পদ্মা নদীর খাশমহাল চরে আত্মগোপনে যায়। মাস খানেক পর গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে আবারও প্রকাশ্য আসে।

গত ২২ জানুয়ারি পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে গেলে মুক্তারপুর সরকারপাড়া গ্রামের শ্রী হিরেন মন্ডলের ছেলে রনজয় মন্ডল ও চক মুক্তারপুর এলাকার হাবিবুর রহমানের ছেলে শাকিলকে পদ্মা নদী থেকে থেকে অপহরণ করে আরিফ-আগুন বাহিনী। রনজয় ও শাকিল দুজনেই মৎস্য অফিসের তালিকাভুক্ত জেলে। তাদের নৌকা, মোবাইলসহ যাবতীয় সবকিছু কেড়ে নিয়ে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে চরে বেঁধে রাখে তারা। একপর্যায়ে অন্য জেলেদের সহায়তায় তারা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তারা।

অপহরণের শিকার রনজয় মন্ডল বলেন, একবার বেঁচে ফিরেছি, এখন আর তাদের ভয়ে নদীতে নামতে পারছি না। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি আরিফ-আগুনের অবস্থানরত ওই চর থেকে সুশীল হালদার নামে এক ভারতীয় জেলেকে অপহরণ করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি দল ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ২৫ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ইন্সপেক্টর মানস চৌধুরীর নিকট হস্তান্তর করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক মাদক কারবারি বলেন, আরিফ-আগুন নিজেরাই ভারত থেকে মাদক আমদানি করছে। পাশাপাশি অন্য মাদক কারবারিদের মাদকও ছিনতাই করছে। তারপর সেসব মাদক নিজেদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জায়গায় সরবারহ করছে। নিজেরা চরে আত্মগোপনে থেকে চারঘাটের মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

চারঘাট মাদক প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাদশা বলেন, আরিফ-আগুন দুই ভাই আতঙ্কের নাম। তাদের ভয়ে জেলেরা নদীতে নামতে পারছেন না। উপজেলার সীমান্তের মাদক কারবার পুরোটা তাদের নিয়ন্ত্রণে।

এ বিষয়ে জানতে আরিফ-আগুনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের বাবা ইউপি সদস্য শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলেরা আগে কিছুটা মাদক কারবারে জড়িত ছিল। আমি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এখন তারা আত্মসমর্পণ করে সঠিক পথে ফিরতে চায়। কিন্তু ভালো পথে ফিরতে না দিয়ে একটি পক্ষ আমার ছেলেদের নামে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ ছড়াচ্ছে।’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ইউসুফপুর কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার মনির হোসেন বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। তবে এরই মধ্যে জেনেছি আরিফ-আগুন এখানকার চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে আমরা কঠোর নজরদারির মধ্যে আছি।’

নৌ পুলিশ চারঘাট ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ বেলাল হোসেন বলেন, এ এলাকায় সবচেয়ে আলোচিত নাম আরিফ-আগুন দুই ভাই। তারা নদীর চরে অবস্থান করে। আমাদের স্পিড বোড কিংবা ট্রলার না থাকায় সেখানে অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না। তবে তারা নজরদারিতে আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চারঘাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলম বলেন, আরিফ-আগুন থানার শীর্ষ ১০ মাদক সন্ত্রাসীর তালিকায় আছে। এলাকায় নানা রকম অপকর্ম করে গহীন চরে অবস্থান করে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলমান আছে। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে তারা দুজন আত্মসমর্পণের কথা আমাদের জানিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বলে অভিযোগ আছে, সেহেতু সেই আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া তাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণযোগ্য হবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close