মো. মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ১৬ মার্চ, ২০২৩

বেনাপোল চেকপোস্টে হুন্ডি চক্র অপ্রতিরোধ্য

প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ও ডলার পাচার হচ্ছে ভারতে

বেনাপোল চেকপোস্টে হুন্ডি কারবারীরা অপ্রতিরোধ্য। আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে হুন্ডির কোটি কোটি টাকা ও ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভরতে। প্রকাশ্যেই আন্তর্জাতিক হুন্ডি চক্র দেশি-বিদেশি কোটি কোটি মুদ্রা পাচার কিংবা লেনদেন করছে। তারা চেকপোস্টেই গড়ে তুলেছে শক্তিশালী চক্র।

কয়েকটি সিন্ডিকেটের বিপুল পরিমাণ মুদ্রা পাচারের কারণে সরকার লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চেকপোস্টের বিভিন্ন মার্কেটে দোকানঘর ভাড়া নিয়ে বসে আছে এক শ্রেণির দোকানদার। কিন্তু দোকানে কোনো মালামাল নেই। অথচ দোকানগুলোতে সবসময় থাকে জমজমাট ভিড়। এসব দোকানে রয়েছে ৬/৭ জন করে কর্মচারী। পাচারের জন্য চেকপোস্টেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি, কম্পিউটার কম্পোজের দোকান, স্টোর, ট্রেডার্স ও এন্টারপ্রাইজ এবং বাহারি নামের ছোট ছোট সাইনবোর্ড যুক্ত দোকান। এসব দোকান থেকেই বিভিন্ন ধরনের চিরকুটের মাধ্যমে, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে পাচার করা হচ্ছে হুন্ডির টাকা ও ডলার।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার পাসপোর্টযাত্রী যাতায়াত করেন ভারতে। কেউ চিকিৎসায়, কেউ বেড়াতে কেউ বা যান ব্যবসায়িক কাজে। ভারতে এসব যাত্রীর মোটা অঙ্কের টাকা ও ডলার প্রয়োজন হয়। বেনাপোল কেন্দ্রিক হুন্ডি কারবারিদের যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কলকাতা, এমনকি মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। চিরকুট, টোকেন, কুরিয়ার সার্ভিস, মোবাইল ফোন, টিটির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে। কথিত মানি চেঞ্জারের নামে এক শ্রেণির এন্টারপ্রাইজ, স্টোর, ট্রেডার্স, ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিসের স্টাফ, আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাকের ড্রাইভার-হেলপার, অবৈধ মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটি আন্তর্জাতিক হুন্ডি ব্যবসায়ীরা দুই পারের চেকপোস্ট এলাকায় গড়ে তুলেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের এসব নিয়মনীতি না মেনে বেনাপোল চেকপোস্টে স্টোর, ট্রেডার্স ও এন্টারপ্রাইজ নামে প্রায় ১০০টির ও বেশি কথিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চেকপোস্টের আশপাশে মুদি, স্টেশনারি দোকানগুলোই হচ্ছে স্টোর, ট্রেডার্স ও এন্টারপ্রাইজ। এসব দোকানে ভুয়া রসিদ, জাল সিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে কোটি কোটি মুদ্রা লেনদেন হচ্ছে।

এর পাশাপাশি ঢাকা-কলকাতা রুটের যাত্রীবাহী বাসের স্টাফরা মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকার কমলাপুর, মতিঝিলসহ অন্যান্য কাউন্টারে টাকা দিয়ে দিলে যাত্রীরা সে টাকা কলকাতা থেকে বুঝে নিতে পারে। ২০টি যাত্রীবাহী বাসের স্টাফ ৭০০-৮০০ পাসপোর্টধারী যাত্রীর টাকা বিনিময় ও পাচারের সব দায়িত্ব পালন করে। এদিকে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাকের ড্রাইভার-হেলপার মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাসহ অসংখ্য ট্রাক চালক-হেলপার আটক হয়েছে বিজিবি ও বিএসএফের হাতে।

এছাড়াও পাসপোর্টের কাজ দ্রুত করে দেওয়ার ও টাকা ভারতে পাঠানোর কথা বলে এসব স্টোর, ট্রেডার্স ও এন্টারপ্রাইজের আরো একটি সিন্ডিকেট যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গুনতে থাকে। এক পর্যায়ে দোকানের ড্রয়ারের মধ্যে ও পায়ের কাছে কিছু টাকা ফেলে দিয়ে ৪/৫ হাজার টাকা গায়েব করে দেয়। এ নিয়ে দোকানদার ও যাত্রীদের বাকবিত-া করতে দেখা যায়। এ রকম অনেক ঘটনায় বিজিবি ও পুলিশ টাকা উদ্ধার করে দিলেও কেউ আটক হয়নি। আর এ কারণে বন্ধ হয়নি এসব সিন্ডিকেট।

বিজিবি জানায়, গত এক বছরে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে পাচারের সময় ৮৮ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার, ২৬ হাজার কেনাডিয়ান ডলার, ৯ লাখ ৯২ হাজার ভারতীয় রুপি, ৫৭ হাজার সৌদি রিয়াল ও ২৬ লাখ টাকা জব্দ করেছেন বিজিবি সদস্যরা। এ সময় ১০ হুন্ডি পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত এক বছরে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাসহ ১০ হুন্ডি পাচারকারী বিজিবির হাতে আটক হলেও আটক হওয়া ব্যক্তিরা প্রকৃত মালিক নন। তারা কমিশনের বিনিময়ে এসব হুন্ডির টাকা পাচার করে থাকে। এভাবে প্রকৃত হুন্ডি কারবারিরা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোসহ আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেও থামছে না হুন্ডি পাচার। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে হুন্ডির কোটি কোটি টাকা ও ডলার পাচার। তারা জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। ফলে পাচার বন্ধ অনেকাংশে বিঘিœত হয়ে থাকে।

বেনাপোলের কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন এলাকায় কিছু অবৈধ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নাম দিয়ে এন্টারপ্রাইজ গড়ে তুলেছে। তাদের মূলত কাজ অবৈধভাবে ভারতে টাকা ও ডলার পাচার করা। এরা চিরকুটের মাধ্যমে এসব টাকা ও ডলার ভারতে পাচার করে এলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর ফলে এদেশের টাকা ডলার চলে যাচ্ছে অন্য দেশে।

বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন ভূইয়া বলেন, চেকপোস্টে মানি চেঞ্জারের পাশাপাশি বেশ কিছু অবৈধ দোকানে অবৈধ টাকা পয়সা লেনদেন হয়ে থাকে। পুলিশ বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে। যাত্রীদের সচেতন করছি। পুলিশ এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে।

যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেনেন্ট কর্নেল আহমেদ হাসান জামিল বলেন, গত এক বছরে বিপুল পরিমাণ দেশি বিদেশি মুদ্রাসহ ১০ হুন্ডি পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। চোরাকারবারিরা ডলার, রুপি, টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে থাকে। বিজিবির গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকায় হুন্ডি পাচার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিজিবির প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close