নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ মার্চ, ২০২৩

শিশুর বিরল রোগ এসএমএ নিরুপায় অভিভাবক

শিশুটির নাম স্বার্থক। ওকে জিজ্ঞেস করা হলে বলে, ‘আমি বড় হয়ে ছোটদের ডাক্তার হতে চাই।’ কিন্তু ও জানে না যে সে এক বিরল রোগে আক্রান্ত।

হাফসার স্মৃতি মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন ইভা-রিপন দম্পতি। গত ডিসেম্বরে তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান ১০ মাস বয়স হওয়ার আগেই মারা যায়। চলে যাওয়া সন্তানের স্মৃতিতে খেলনা, পানির পট, জুতা, কাপড় কত কিছুই না আছে তালিকায়। সবকিছু যখন বের করে সন্তানের স্মৃতি রোমন্থন করা হচ্ছে তখন এই দম্পতির অশ্রু যেন আর বাধ মানে না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইভা বলছিলেন, ‘বাবুর জন্মের সময়ও সবকিছু ঠিক ছিল। বয়স অনুযায়ী ওর অন্যান্য কার্যক্রম সব স্বাভাবিক ছিল। বাবু ঠিকমতো খেত, হাত-পা নেড়ে খেলাধুলা করত, ডাকত। শুধু ঘাড় শক্ত হচ্ছিল না। বাবুর বয়স ৫ মাস পার হওয়ার পরই আমাদের চিন্তা শুরু হয়। তখন আমরা একজন শিশুবিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার দেখে জানান, ডেভেলপমেন্ট ডিলে। তারপরও আমরা একজন পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাই। তিনি বাবুকে দেখে ধারণা করেন, বাচ্চার এসএমএ (স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রোফি) হতে পারে। তখন মুভ করতে শুরু করি।’

যেন সন্তানের মৃত্যুর অপেক্ষা : এমনি এক পরিবার সিলেটের ফারজানা-জুনায়েদ দম্পতির। ফারজানা বলেন, ‘ডাক্তার যখন আমাদের বললেন, আমাদের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি কখনো শুনিনি এই রোগের নাম। জানতামও না এই রোগ সম্পর্কে। পরে আমরা রিপোর্টের মাধ্যমে কনফার্ম হলাম ওর এসএমএ টাইপ-১। ওকে (সন্তান) নিয়ে আমরা খুব টেনশনে আছি। চিকিৎসা কী করব বুঝতে পারছি না।’

জুনায়েদ বলেন, ‘আসলে আমি দেখতে পাচ্ছি আমার বাচ্চাটা চোখের সামনে মারা যাচ্ছে। একজন বাবা হয়ে এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, এসএমএ টাইপ-১ হলে বাচ্চারা বেশি দিন বাঁচে না। আমার বাচ্চার বয়স ৭ মাস হয়ে যাচ্ছে।’

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) : এটি একটি জটিল জিনগত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। তবে তাদের বুদ্ধি সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও জটিলতার কারণে এসব শিশুরা চিকিৎসা না পেলে অল্প সময়ে মারা যায়। এটা একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার, যেটি মূলত মোটর নিউরন সংলগ্ন স্নায়ুগুলোকে অক্ষম করে দেয়, ফলে এসব স্নায়ু নিয়ন্ত্রিত মাংসপেশিগুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারায়। সাধারণত শরীরে যেসব মাংসপেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে, খাবার গিলতে, বসার সক্ষমতায়, হামাগুড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং সর্বোপরি হাঁটতে পারার জন্য কার্যকরি, এসএমএ আক্রান্ত হলে সেগুলো দুর্বল হয়ে যেতে যেতে একসময় পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যায়।

বাংলাদেশে এসএমএ রোগীর সংখ্যা : বাংলাদেশে এসএমএ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা কত তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। এমনকি এই রোগ শনাক্তের কোনো ব্যবস্থাও নেই। বিদেশে নমুনা পাঠিয়ে এ রোগ শনাক্ত করতে হয়। তবে পরীক্ষা না করালেও কিছু উপসর্গ দেখে এই রোগ সম্পর্কে ডাক্তাররা ধারণা করতে পারেন।

ব্যয়বহুল চিকিৎসা : বিশ্বে জেনেটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যেসব বাচ্চারা মারা যায় এসএমএ তার শীর্ষে। দেশে এই রোগে আক্রান্ত অনেক শিশু রয়েছে। এ বিষয়ে তানজিনা ইভা বলেন, যেদিন জানলাম বাবুর এসএমএ হয়ে থাকতে পারে সেদিন কান্না থামাতে পারিনি। আমরা কী করব তা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ, খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এসএমএ নির্ণয়ের পরীক্ষা আমাদের দেশে হয় না। আর চিকিৎসাও অনেক ব্যয়বহুল। পরে ২০ হাজার টাকা দিয়ে আমরা বাবুর ব্লাডের নমুনা ভারতে পাঠাই। বাবু মারা যাওয়ার পর আমরা সেই রিপোর্ট পাই। তাতে দেখা যায়, বাবুর এসএমএ টাইপ-১ ছিল।

২০১৬ সালের আগে রোগ শনাক্তকরণ এবং তার লক্ষণগুলো প্রতিরোধ করা ছাড়া তেমন কোনো চিকিৎসা প্রচলিত ছিল না বা আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু বর্তমানে তিনটি প্রক্রিয়ায় এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রথম এসএমএ চিকিৎসাসেবা পায় নবনী : ২০২২ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশের জন?্য একটি স্মরণীয় দিন। এদিন ৯ মাস বয়সি শিশু অলিভিয়া সঞ্চারি নবনীকে মুখে খাওয়ার ওষুধ প্রথম ডোজ দেওয়ার মধ?্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় এসএমএ’র চিকিৎসা। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজির সহকারী অধ?্যাপক ডা. শাওলী সরকারের অধীনে নবনীর চিকিৎসা হয়। এই ওষুধটি রোশ বাংলাদেশ লিমিটেড সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরবরাহ করে।

বাংলাদেশে এসএমএ চিকিৎসা সেবাপ্রাপ্ত প্রথম শিশু নবনী কোনো রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই এই মেডিসিন গ্রহণ করছে। সম্প্রতি রোশ বাংলাদেশ লিমিটেড ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

২২ কোটি টাকার জিন থেরাপি পেয়েছে রায়হান : দেশে প্রথমবারের মতো ২২ কোটি টাকা মূল্যের জিন থেরাপি দেওয়া হয় শিশু রায়হানকে। এর মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল। পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. জোবাইদা পারভীনের অধীনে শিশু রায়হানের চিকিৎসা হয়। সংশ্লিষ্টরা এটিকে চিকিৎসাসেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন বললেও খরচ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ওষুধ প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কোম্পানি নোভারটিস লটারির মাধ?্যমে বিনামূল্যে এই ডোজ সরবরাহ করে।

চিকিৎসকরা যা বললেন : ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে হাসপাতালের ডা. জোবাইদা পারভীন বলেন, স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ)-এর ধরন চারটি। টাইপ-১ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো বাচ্চার টাইপ-১ হলে সর্বোচ্চ ২ বছরে বাঁচে। তবে চিকিৎসা না পেলে ৬০-৭০ শতাংশ শিশু এক বছরের মধ্যেই মারা যায়। টাইপ-২ এর বাচ্চারা ২০ থেকে ২৫ বছর বাঁচে। এই বাচ্চাদের মাংসপেশি শুকিয়ে যেতে থাকে এবং অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না।

ডা. জোবাইদা পারভীন বলেন, আমাদের দেশে আসলে এই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার জন্য পুরোপুরি ব্যবস্থাটা নেই। সেক্ষেত্রে পাশের দেশে বাচ্চাদের ব্লাড পাঠানো হয়। এছাড়া, গর্ভাবস্থায় গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড পরীক্ষা করেও এসএমএ নির্ণয় করা যায়। তখন কোনো মা-বাবা চাইলে সেই বাচ্চা রাখতে পারে আবার নাও রাখতে পারে।

এসএমএ রোগের চিকিৎসার বিষয়ে ডা. জোবাইদা পারভীন বলেন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে হাসপাতালে এসএমএ আক্রান্ত শিশু রায়হানকে ‘জিন থেরাপি’ দেওয়া হয়েছে। এই থেরাপির প্রতি ডোজের বাজার মূল্য প্রায় ২২ কোটি টাকা। এটা কোনো একক পরিবারের পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব। আমরা চাই, রায়হানের মতো আরও যেসব বাচ্চা এই রোগে আক্রান্ত তারাও চিকিৎসা পাক। এজন?্য সরকার, বিত্তবান এবং দাতাসংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ?্যাপক ডা. শাওলী সরকার বলেন, স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি একটি বিরল জেনেটিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের শরীর তুলতুলে নরম থাকে, ঘাড় শক্ত হয় না, উঠতে বা বসতে পারে না। তবে কথা বলতে পারে, যোগাযোগ করতে পারে কারণ বুদ্ধি স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু শরীরের নড়াচড়া কম থাকে, ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টের কারণে শ্বাসের জন্য যে মাংসপেশি তা দুর্বল হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে মারা যায়।

তিনি আরো বলেন, আমরা অলিভিয়া সঞ্চারি নবনী নামের একটা বাচ্চাকে মুখে খাওয়ার ওষুধ ‘রিসডিপ্লাম’ দিয়ে দেশে প্রথম এসএমএ রোগীর চিকিৎসা শুরু করতে পেরেছি। ‘রোশ বাংলাদেশ’ বিনামূল্যে এই ওষুধ সরবরাহ করেছে।

বাংলাদেশে জেনেটিক ল্যাব ও ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন

এসএমএ রোগে আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকরা রোগ প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে জেনেটিক ল্যাব স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে এসএমএ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া হাফসার মা তানজিনা ইভা বলেন, আমরা একটা ফাউন্ডেশন গঠনের চেষ্টা করছি। অন্তত এ রোগে আক্রান্ত বাচ্চারা যেন চিকিৎসা পায়। আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, বাংলাদেশে কোনো জেনেটিক ল্যাব নেই। যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে যেন একটা জেনেটিক ল?্যাব প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এসএমএ আক্রান্ত শিশু নবনীর বাবা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, রোশ বাংলাদেশ লিমিটেড ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ‘রিসডিপ্লাম’ ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করবে। তারপর আমরা কী করব। ওষুধ চালিয়ে নিতে না পারলে আমরা বাচ্চাকে বাঁচাতে পারব না। আজীবন এই ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। এটা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা অভিভাবকরা মিলে একটি ফাউন্ডেশন গঠনের চেষ্টা করছি। যাতে আমার বাচ্চা ও আক্রান্ত সব বাচ্চাকে চিকিৎসাসেবার আওতাভুক্ত করতে পারি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ?্যাপক ডা. শাওলী সরকার বলেন, এই রোগের চিকিৎসা, বিশেষ করে জিন থেরাপি খুব ব্যয়বহুল। বেশির ভাগ এর ব্যয় বহন করা একক পরিবারের জন্য অত্যন্ত দুরূহ। এই রোগীদের সেবা দিতে হলে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের সহায়তায় সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন। আমরা প্রত্যাশা করি, এসএমএ আক্রান্ত অন?্য শিশুরাও চিকিৎসাসেবা পাবে। তবে এর জন্য সরকার ও বিত্তবানদের পক্ষ থেকেও সহায়তা প্রয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close