সালাহ্উদ্দিন শুভ, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)

  ১৬ মার্চ, ২০২৩

কমলগঞ্জে গ্যাস অনুসন্ধানে ড্রিলিং

আগুনে পুড়ল রাজকান্দি বনের তিনটি টিলা

সিলেট বিভাগের সমৃদ্ধ বনাঞ্চল হচ্ছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রাজকান্দি সংরক্ষিত বন। বনটি হামহাম জলপ্রপাতের জন্য পর্যটকদের কাছেও খুবই পরিচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই বনকে অনেক গবেষক বন্যপ্রাণীদের ‘হটস্পট’ বলে অভিহিত করেন।

৩ সপ্তাহ ধরে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে ড্রিলিং কার্যক্রম শুরু করেছে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (সিএনপিসি)। এরই মধ্যে বুধবার (১৫ মার্চ) রাজকান্দি বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া এলাকার তিনটি টিলা আগুনে পুড়ে যায়। একে জীববৈচিত্র্য ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর জন্য হুমকির কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের শর্তসাপেক্ষে অনুমতি নিয়ে ৩-ডি সাইসমিক জরিপ কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। মন্ত্রণালয়ের শর্তাদির মধ্যে রয়েছে তুলনামূলক গাছপালাবিহীন ফাঁকা স্থানে ড্রিলিং করা, বনের ভেতরে যানবাহন প্রবেশ না করা ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো কার্যক্রম না করা, গাছপালা কাটা ও বনজ সম্পদের ক্ষতি না করা। কিন্তু তার কোনো শর্তই মানা হচ্ছে না।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সার্ভে, ড্রিলিং ও রেকর্ডিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করে বিজিপি, চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। পেট্রোবাংলার তত্ত্বাবধানে ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের নির্দেশনায় অ্যাকরেজ ব্লক-১৩ ও ১৪ এর অবমুক্ত এলাকায় ৩-ডি সাইসমিক জরিপ প্রকল্প গত জানুয়ারি পর্যন্ত বস্তি, চা বাগান ও হাকালুকি হাওর এলাকায় কার্যক্রম সম্পন্ন করে। সে সময় বস্তির বেশ কিছু বসতঘরের দেয়ালে ফাটল ধরার অভিযোগ উঠে। সবশেষে রাজকান্দি বনাঞ্চলে শর্তসাপেক্ষে জরিপ কাজের অনুমতি পায় ওই চায়না প্রতিষ্ঠান। তবে গ্যাস অনুসন্ধানে সংরক্ষিত বনে জরিপ কাজ জীববৈচিত্র্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কমলগঞ্জ রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর বন বিট কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, এই বনাঞ্চলে লাউয়াছড়ার চেয়েও বেশি বন্যপ্রাণী রয়েছে। বনাঞ্চলটি এখনো ঘন সন্নিবেশিত। বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় অনেক বন্যপ্রাণীও এখানে রয়েছে।

পরিবেশবাদীরা বলেন, ‘আমাদের মতে পার্বত্য এলাকা ছাড়া এত সমৃদ্ধ বন বাংলাদেশে আর নেই। এই বনে এমন অত্যাচার আমাদের আহত করেছে। দেয়ালে পিঠ আটকে গেছে আমাদের। আন্দোলন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। যদিও আন্দোলন বা যৌক্তিক কোনো কিছুই কেউ শোনার নেই এখন। যার যেভাবে স্বার্থ যা, ইচ্ছা তাই করছে।’

বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও নিরাপদ আবাসস্থলে গ্যাস অনুসন্ধানে উদ্বেগ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক মুনতাসির আকাশ জানান, ‘রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে আমরা ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে গত বছর ৬ মাস গবেষণা করেছি। সিলেট বিভাগে প্রথমবারের মতো এশীয় কালো ভালুক, বন-ছাগল, সোনালি বিড়াল, এশীয় ছোট নখযুক্ত ভোঁদড়, চীনা প্যাঙ্গোলিনসহ প্রায় ৪০ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ছবি ও স্থায়ী পপুলেশনের অস্তিত্ব আমরা পেয়েছি। এর সবই বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে। এছাড়া এ বনে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির আবাস। যার অনেকই পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন বন ছাড়া দেখা যায় না। এত সমৃদ্ধ বন আর এ নিয়ে এত তথ্য এই সিলেট বিভাগে কমই আছে। যেখানে আমরা মনেপ্রাণে চাই রাজকান্দি বনকে জাতীয় উদ্যান বা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হোক, সেখানে ড্রিলিং আর ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণের মতো কাজ অত্যন্ত বেদনার এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, ‘আমাদের মাথায় আসে না মন্ত্রণালয় কীভাবে এর অনুমতি দেয়। আমরা আগেও দেখেছি সংরক্ষিত বনে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশকে নষ্ট করে গ্যাস অনুসন্ধান করতে। বনের মধ্যে বিস্ফোরণের কারণে বন্যপ্রাণী ও পাখিরা অন্যত্র ছুটে যাবে। আমরা বারবার এ নিয়ে কথা বলেছি, আন্দোলন করেছি কিন্তু দায়িত্বশীলদের কানে তালা।’

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ভাল্লুক, বনছাগলসহ বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর উল্লেখ্যযোগ্য আবাসস্থল রাজকান্দি বনাঞ্চল। সেখানে ড্রিলিং ও শুটিং করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো কারণে যদি মাগুরছড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আরো মারাত্মক হবে।’ বনে আগুন লাগার বিষয়ে রাজকান্দি বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বনে আগুন লেগেছিল তবে সেটি যথাসময়েই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তাছাড়া আরো খতিয়ে দেখা হচ্ছে কেন আগুন লেগেছিল।’

এ ব্যাপারে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বলেন, ‘আগুন আমাদের জন্য লাগেনি। আগুন লাগার ঘটনাটি সত্য। আমরা নিজেরাও এর কারণ অনুসন্ধান করেছি। আমরা জেনেছি যে, যেসব জায়গায় আগুন লেগেছে তা স্থানীয় বসতির কাছাকাছি। এসব বসতির মানুষের অসতর্ক কোনো কারণেও লাগতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহকারীরাই আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। আমরা মাইকিং করেও সতর্কতা করেছি। আমরা বনের ভেতর যানবাহন নেই না, আধা কিলোমিটার দূরে রাখি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বনের মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ড্রিলিং কাজ করছি। মন্ত্রণালয়ের সব শর্তাবলি মেনেই কাজ চলমান রয়েছে। তিনি আরো জানান, ১৯-২০ মার্চ নাগাদ এখানে ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণের কাজ শুরু হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close