আরিফ খাঁন, বেড়া-সাঁথিয়া (পাবনা)

  ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

বিলীন হচ্ছে কালের সাক্ষী

পাবনা বেড়ার তেরো জমিদারবাড়ি কালের পরিক্রমায় ভগ্নদশায় পড়েছে। গ্রামের এই ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখার জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। আছে শুধু ভাঙাচোরা পলেস্তারাখসা বিশাল অট্টালিকা, শানবাঁধানো পুকুর, বাড়ির প্রবেশমুখে বাঘ-সিংহের পাথরের মূর্তি। এলাকার মানুষ এই সামাজিক ইতিহাসের সাক্ষী হারাতে চান না। তবে তারা হতাশ, কারণ সংরক্ষণের অভাবে দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে কালের সাক্ষী এসব স্থাপনা।

জানা গেছে, বেড়া উপজেলার বিখ্যাত তেরো জমিদারবাড়ি কালের পরিক্রমায় আজ ভগ্নদশায় উপনীত হয়েছে। উপজেলার হাঁটুরিয়া গ্রামে এই জমিদারির গল্প আজও লোকমুখে গল্পের মতো ঘোরে। জমিদারির পাইক-পেয়াদার কথা, গানের আসরের কথা, পাশেই যমুনা নদীতে রাজাদের প্রমোদতরীর কথা- এসব আজ মানুষের মুখে কেবল গল্প। একসময় এ গ্রামে তেরো জন জমিদার বাস করতেন। তাই এই গ্রাম তেরো জমিদারদের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এই তেরো জমিদারের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা। বর্তমানে ভাঙাচোরা পলেস্তারাখসা দালান আর কয়েকটি পুকুর ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। গ্রামটি উপজেলা শহর থেকে একটু ভেতরে হওয়ায় গ্রামটির অবস্থাও তেমন সুবিধাজনক নয়। সব মিলিয়ে জমিদারদের এই গ্রাম আজ অনেকটাই উপেক্ষিত। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই হাটুরিয়া গ্রাম। বড় বড় বণিকরা বাস করতেন এ অঞ্চলে। গ্রামের পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র নাকালিয়া বাজারের সঙ্গে কলকাতার নৌপথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। একশ বছর আগে এ গ্রামে দুই একজন জমিদারের বাস ছিল। পরে এখানে জমিদারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় এ সংখ্যা দাঁড়ায় তেরোতে। তেরো জন জমিদার হলেন- প্রমথনাথ বাগচী, কাঞ্চীনাথ বাগচী, উপেন্দ্রনাথ বাগচী, ভবানীচরণ বাগচী, কালীসুন্দর রায়, ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়, সুরেন চন্দ্র রায়, সুধাংশু মোহন রায়, শক্তিনাথ রায়, বঙ্কিম রায়, ক্ষুদিরাম পাল, যদুনাথ ভৌমিক ও যতীন্দ্রনাথ ভৌমিক। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে, এসব জমিদারের বসবাসের সময়কাল ছিল আনুমানিক ১৯১৫ সাল বা এর পর থেকে।

জমিদারিপ্রথা বাতিল হওয়ার আগপর্যন্ত তারা এ গ্রামেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। হাঁটুরিয়া গ্রামের জমিদারের কথা উঠলেই লোকমান পেয়াদার কথা ওঠে। সে সময়কার একমাত্র সাক্ষী ছিলেন এই লোকমান পেয়াদা। জমিদার প্রমথনাথ বাগচীর পেয়াদা ছিলেন তিনি। তার বাবা-দাদাও জমিদারের পেয়াদা ছিলেন। তার মুখ থেকে শোনা কাহিনীতে জানা যায়, ১৩ জমিদারের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাবৎসল ছিলেন প্রমথনাথ বাগচী। আর প্রজাপীড়ক ছিলেন যদুনাথ ভৌমিক। এক গ্রামে এত জমিদার থাকলেও তাদের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতো না। বরং বিভিন্ন পূজাপার্বণে সবাই মিলেমিশে উৎসব পালন করতো। জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশভাগের আগে-পরে একে একে সবাই স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে যান। জমিদারদের প্রত্যেকেই বাস করতেন প্রাচীরঘেরা অট্টালিকায়। অট্টালিকার পাশেই ছিল শানবাঁধানো ঘাট। সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বর্তমানে বেশিরভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যে কয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে তার অবস্থাও করুণ। একই রকম অবস্থা বড় বড় অট্টালিকাগুলোর। মালিকানা বদলের পর কিছু অট্টালিকা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিছু কিছু যত্নের অভাবে ভেঙে গেছে। সাক্ষী হিসেবে গ্রামে এখনো দু-তিনটি অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ আজও রয়ে গেছে। জরাজীর্ণ এসব অট্টালিকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন কয়েকটি পরিবার। এমনি একটি পরিবার দ্বিতল অট্টালিকায় বসবাস করা দিলীপ গোস্বামীর পরিবার। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ইজারা নিয়ে তারা বসবাস করছেন। দিলীপ গোস্বামীর ছেলে দীপক গোস্বামী জানান, অট্টালিকার এক স্থানে এর নির্মাণকাল ১৯১১ সাল এবং নির্মাতা হিসেবে জমিদার ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়ের বাবা উমেশ চন্দ্র রায়ের নাম খোদাই করা ছিল। তিনি ছেলেবেলায় এখানে সুপরিসর জলসাঘরসহ অনেক কক্ষ দেখেছেন। হলরুমে ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষের ছবি ছিল। জলসাঘরসহ সব কক্ষই জরাজীর্ণ। ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তারা এখানে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।

হাঁটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের নুরে আলম বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ গ্রামটির সমস্যার কথা বলে শেষ করা যাবে না। ভাবতে অবাক লাগে ১৩ জমিদার বসবাস করা গ্রামটির আজ এই করুণ দশা। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার বাড়িগুলো। এসবের অনেকগুলোই আজ দর্শনার্থীদের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার কালের পরিক্রমায় অনেক জমিদার বাড়িই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।

গ্রামে বিভিন্ন সমস্যার কথা স্বীকার করে হাঁটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ সরকার বলেন, সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি বিলীন হতে বসা ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close