মেহেদী হাসান
ভয়াবহ মাদক এলএসডি বাঁচা-মরার লড়াই
এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ * মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের জন্য পরিচিত * প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাশ দমনে কার্যকর

আধুনিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ মাদকের একটি লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড; সংক্ষেপে এলএসডি। বাংলাদেশে এটির নাম আলোচনায় আসে গত বছরের ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের পর। এই অ্যাসিড এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ, যা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের জন্য পরিচিত। এটি প্রধাণত প্রমোদমূলক ওষুধ হিসেবে এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশে ব্যবহৃত হয়। এলএসডি সাধারণত জিভের নিচে রেখে ব্যবহার করা হয়।
সে সময় নিজের গলায় নিজেই দা চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন হাফিজুর রহমান। এই মাদক গ্রহণ করার পরই আত্মহত্যা করেন তিনি। পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ১৫ মে রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢামেকের সামনে এক ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটেন হাফিজুর। তখন উন্মাদের মতো হাফিজুর বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে মাফ করে দাও’। তিনি সেখানেই মারা যান। এরপর হাফিজের বন্ধুসহ বিশ্ববিদ্যালয়পডুয়া তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে এলএসডির ২০০টি ব্লট (মেশানো কাগজ) উদ্ধার করা হয়।
এলএসডির আবিষ্কার : সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যানই প্রথম পরিচয় করে দেন এলএসডির সঙ্গে। তিনি মোটেও মাদক হিসেবে ব্যবহারের জন্য এটি তিনি আবিষ্কার করেননি। ত্রিশের দশকে এরগট নামক এক ধরনের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস দমনের কার্যকরী ওষুধ হিসেবে এলএসডি আবিষ্কার করেন হফম্যান।
আসলে তিনি কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করার ওষুধ তৈরির জন্য লাইসার্জিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করছিলেন। তখন হঠাৎ করেই নিজের অজান্তে এলএসডি নামক আধুনিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ ড্রাগের প্রভাব আবিষ্কার করতে সক্ষম হন তিনি।
১৯৩৮ সালে হফম্যান এই মাদক আবিষ্কার করার পর এটি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর হফম্যান আবার এলএসডি-২৫ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করালেন। এরপরই তিনি চলে যান স্বপ্নের জগতে। পরের দিন হফম্যান তার জিভে নিলেন ২৫০ মাইক্রোগ্রাম। যা আগের দিনের দশগুণ বেশি। ফলাফল একই ছিল, তবে ঘাবড়ে যান হফম্যান। দ্রুত চিকিৎসককে ডেকে নিজের ব্লাডপ্রেশার, হার্টরেট, শ্বাস-প্রশ্বাস সবই পরীক্ষা করান। সবই ঠিক ছিল।
এরপর হফম্যানের সহকর্মীরা একে একে সবাই স্বাদ, বর্ণ ও রংহীন সেই সাইকেডেলিক ড্রাগ টেস্ট করলেন। সবাই এটি ব্যবহারের পরপরই নতুন এক জগতের দেখা পেলেন। যা চিন্তা-ভাবনাকে মুহূর্তেই প্রভাবিত করতে পারে। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় ভয়াবহ মাদক এলএসডি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এই মাদক সেবনের পর মস্তিষ্কে খারাপ এবং ভাল দুটি প্রভাবই কাজ করতে পারে। যখন ভালো দিকটি কাজ করে তখন মানুষ স্বপ্নের জগতে চলে যায়। আর যখন এটির খারাপ প্রভাব কাজ করে তখন মানুষ এক ভয়ংকর অন্ধকার জগতে চলে যায়। যার পরিণামে অনেকে অত্মহত্যাও করেন। তাপমাত্রার সঙ্গেও এর প্রভাব জড়িত।
এলএসডি সেবনের অভিজ্ঞতা ও প্রভাব
এ বিষয়ে আমাদের কথা হয় এলএসডি সেবন করা এক বিদেশপড়ুয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে। যিনি ২০১৮ সালে এটি সেবন করেছিলেন। তিনি এই মাদক সেবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা এই প্রতিবেদককে জানান।
তিনি বলেন, একবার তিনি কৌতূহলবশত বন্ধুদের সঙ্গে এলএসডি সেবন করেন। এরপর এই মাদক তাকে নিয়ে যায় জীবন মৃত্যুর মাঝখানে। তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরতে যান। সঙ্গে নিয়ে যান একটি গাড়ি, যা তারা নিজেরাই চালাচ্ছিলেন। এরপর রাতে তারা প্রত্যেকেই ৫ মাইক্রোগ্রাম করে এলএসডি সেবন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই শিক্ষার্থী জানান, সেটাই ছিল তার জীবনের প্রথম এবং শেষ এলএসডি সেবন। সেবনের কিছুক্ষণ পরই তাদের মস্তিষ্কে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিল তাদের। এরপর তারা হোটেলে চলে আসেন। সে সময় তার বন্ধুরা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন। হোটেল কক্ষ ভাঙচুর করেন। এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন, তারা এই অবস্থায়ই নিজেদের বাসায় ফিরবেন এবং তৎক্ষণাৎ তারা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি নিয়ে বাসার পথে রওনা হন। রাস্তাটি ছিল পাহাড়ি এবং খুবই বিপজ্জনক। তার এক বন্ধু গাড়ি চালাচ্ছিলেন, যিনিও এই মাদক সেবন করেছেন। কিন্তু তার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
তিনি বলেন, এ সময় গাড়িতে বন্ধুদের কার্টুনের মতো মনে হচ্ছিল। এক সময় তারা গাড়ি থামিয়ে মূত্রত্যাগ করতে নামেন, তখন তার মনে হচ্ছিল আশপাশের দৈত্য দানব তাকে ধরতে আসছে এবং তিনি রক্ত ত্যাগ করছেন। ভয় ও আতঙ্কে তিনি দৌড়ে গাড়িতে চলে আসেন। কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না তিনি। তাদের মধ্যে ২ জনের মনে হচ্ছিল- তারা মলত্যাগ করে ফেলেছেন। কিন্তু তারা তা করেননি।
বিদেশপড়ুয়া শিক্ষার্থী আরো বলেন, আশপাশের মানুষকে দৈত্য দানব মনে হচ্ছিল এবং নিজেকে চোর, ডাকাত মনে হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, তারা তাকে ধরে নিয়ে যাবে। এক সময় তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করেন এবং তওবা করতে থাকেন যদি বেঁচে ফেরেন জীবনে আর কোনোদিন এমন ভুল করবেন না। ১৬ ঘণ্টা পর তিনি সুস্থ হন। এ মাদক এতটাই ভয়াবহ যে তা সেবনের পর ব্যক্তি তার কাছের মানুষকে হত্যা করতে পারে।
"