কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

রাজনীতিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহারের অভিযোগ

চট্টগ্রামে ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ বেপরোয়া

নিজেদের স্বার্থরক্ষা না হলে প্রকৌশলী কর্মকর্তা, শিক্ষক পরিবেশকর্মীর ওপর চড়াও

রাজনীতিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ক্ষমতাসীন দলের বড় একটি অংশ- এই অভিযোগ চট্টগ্রামে নতুন নয়। আরো অভিযোগ আছে, দলবাজিতে লিপ্ত এসব নেতাকর্মীর কারণে নষ্ট হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের এসব নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়া নেতাকর্মীদের কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থেকে অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় না। নিজেদের স্বার্থরক্ষা না হলে তারা প্রকৌশলী, আমলা, শিক্ষক, পরিবেশকর্মীর ওপর চড়াও হয়ে তাদের মারধর করতে পিছপা হচ্ছে না তারা।

চট্টগ্রামে কয়েক দিন আগে পাহাড় কাটা ও খাল ভরাট দেখতে গিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল আলম জসিমের বাধার মুখে পড়েন পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সাংবাদিকদের নিয়ে তিনি নগরীর আকবর শাহ এলাকায় যাওয়ার পর প্রশ্নের মুখে পড়েন। এক সময় তাকে ঘিরে হামলার আয়োজন চলে। শেষ পর্যন্ত গাড়ি আটক করে বলা হয়, এখানে কেউ এলে সহজে ফিরতে পারবেন না। এলাকা পরিদর্শনের সময় সৈয়দা রিজওয়ানাকে হেনস্থা করার জন্য তার পেছনে লোক লেলিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে পুলিশের হস্তক্ষেপে গাড়ি উদ্ধার করা হলেও রিজওয়ানা হাসানকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া হয়। এ ঘটনার পর মামলা হলেও জামিন পেয়ে যান কাউন্সিলর ও তার লোকজন।

এ ঘটনার রেশ যেতে না যেতে রবিবার (২৯ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীর ওপর প্রকাশ্যে হামলা করে ঠিকাদারদের একটি গ্রুপ। অভিযোগ উঠেছে, এই ঠিকাদাররা একাট্টা হয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। এদের মধ্যে রয়েছে সরকারি দলের সমর্থক ঠিকাদারও। বড় বড় নেতার হয়ে কাজ করেন অনেকে। চট্টগ্রাম মহনগরীর আন্দরকিল্লায় পুরোনো নগর ভবনে ছিল সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভা। এ সভা শেষে টাইগারপাসের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ে নিজের দপ্তরে আসেন প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামে ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ উন্নয়নে প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় গোলাম ইয়াজদানী। তিনি বাইরে থেকে প্রেষণে এই নিয়োগ পান। নতুন এ প্রকল্প পরিচালক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আলোকে কাজ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। তার কক্ষের ভেতরেইতার ওপর হামলা চালায়১৫ থেকে ২০ জন ঠিকাদার। তাকে শারিরীকভাবে হেনস্থা করা হয়, তার নামফলক, কাচের টেবিল ও বিভিন্ন সরঞ্জাম ভেঙে ফেলা হয়। স্বচ্ছ দরপত্র প্রক্রিয়ায় কাজ না পেয়ে এসব ঠিকাদার ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্প পরিচালককে মারধর করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঠিকাদারদের একটি অংশ জানায়, এ হামলার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েক নেতার ইন্ধন আছে। তারা বলেন, সিটি করপোরেশনে যে পদ্ধতিতে দরপত্রের লটারি হতো তা সঠিক ছিল না। লটারি হতো শুধু নামেই, মূলত ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে কাজ বণ্টন হতো। এ ভাগের টাকা চলে যেতো প্রকৌশলী ও সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটে। নতুন প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী দায়িত্ব নেওয়ার পর ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ইজিপির) মাধ্যমে কাজ বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ এই প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করার সুযোগ নেই। অনিয়ম করতে না পেরে ঠিকাদারদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। অভিযোগ উঠেছে, তাদের পেছনে সিটি করপোরেশনের পদস্থ কর্মকর্তারা ও কলকাঠি নাড়েন। ফলে ঠিকাদার ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রকল্প পরিচালকের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে।

ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ঘটনার পর প্রকৌশলীরা তাঁর সাথে দেখা করে বিস্তারিত বলেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি আমি শুনেছি। প্রকল্প পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীকে মারধরের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি এরই মধ্যে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘটনার জন্য মামলা হয়েছে। হামলাকারী যেই হোক না কেন আইন তার নিজ গতিতে চলবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

এদিকে পিছিয়ে নেই ছাত্রলীগও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে চবি উপাচার্যের দপ্তরে হামলা করে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ। ছাত্রলীগের এক নেতা ছিলেন প্রার্থী। তাকে কেন নিয়োগ দেওয়া হলো না- এ অভিযোগ এনে তারা ভিসির দপ্তরে হামলা চালায়। শাটল ট্রেনও আটকে দেয়। রায়হান আহমেদ নামের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়োগ না দেয়ায় ছাত্রলীগের একাংশ এ ঘটনা ঘটায় বলে জানা যায়।

দলের কিছু নেতার এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি নগর আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সিটি প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে যেগুলো হচ্ছে তাতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। নেত্রী শেখ হাসিনা দলের জন্য, দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্ত কথিত কিছু নেতা সব জায়গায় দলকে ব্যবহার করে ব্যবসা বাণিজ্য করে চলেছেন। তাদের কাছে দলের চেয়ে টাকা বড়। তিনি বলেন, মুষ্টিমেয় এসব নেতার কারণে দলের সব অর্জন শেষ হতে চলেছে। এগুলোর রাশ টেনে না ধরলে দলকে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close