দেলোয়ার হোসেন, বাউফল (পটুয়াখালী)

  ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

সারা জীবন নৌকায়

সোনালি সকাল, রোদেলা দুপুর ও পড়ন্ত বিকালের গোধূলি শেষে সন্ধ্যা হলে বেশকিছু বাতি ও সোলার লাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর তীর। কাঠের তৈরি নৌকায় জলে ভেসে ভেসে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ছোট্ট একটা নৌকাই যাদের ঘর-বাড়ি-সংসার। নৌকাতে জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য আর সেই নৌকাতেই মৃত্যু।

সারা দিন রোদে পুড়ে অথবা বর্ষায় কাকভেজা হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে বিভিন্ন নদীর কিনারে। দিনভরের রোজগার দিয়ে সন্ধ্যায় চুলা জ্বালায় নৌকার ছাউনিতেই। রাতেই হয় ভোজন। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে থাকা মান্তা সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো।

আধুনিক সভ্যতা থেকে ছিটকে পরা এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষজন, তারা নিজেদের মান্তা জনগোষ্ঠী বলে দাবি করেন। বাংলাদেশের নাগরিক হলেও অন্যদের মতো সাধারণ মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম এই জনগোষ্ঠী। দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত অনেক কৃষিজীবী পরিবার এবং চিরাচরিত মান্তা জনগোষ্ঠীর এই পরিবারগুলো এখন তেঁতুলিয়া নদীসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ নদীতে তারা নৌকায় বসতি গড়ে তুলেছে। বাকেরগঞ্জ- বাউফল-দশমিনা-গলাচিপা উপজেলার বিভিন্ন নদীর কুল ঘেঁষা, লোহালিয়া, তেঁতুলিয়া, বুড়াগৌরাঙ্গ এবং ডাকুয়া, নদীর তীরে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নাই স্বাস্থ্যসেবা অথবা পরিবার পরিকল্পনা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির নিয়মণ্ডকানুন জানা। বেশির ভাগই রোগবালাই সারতে যান কবিরাজ, বৈদ্যের কাছে। একটু বয়স হলেই সন্তানরাও মাছ ধরায় সাহায্য করে বাবা-মাকে। স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগেরই। দেশের প্রধানত উপকূলবর্তী জেলা-উপজেলাগুলোর নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা। প্রতিটি নৌকাতে একটি করে পরিবার, সে পরিবারের সব সুখণ্ডদুঃখ, হাসি-কান্না মিশে আছে ওই ছোট্ট নৌকাটিতে। মান্তা জনগোষ্ঠী পরিবারের সদস্য শাহিন হাওলাদার বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলার বাসিন্দা ছিলেন তারা। নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে তারা প্রথমে বাউফল উপজেলার তেঁতুলিয়া তারপর বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর কিনারে ঘাঁটি বাঁধে, তারপর থেকেই তারা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এই নদীর কিনারে বসবাস করে যাচ্ছেন, দিন-রাত মাছ ধরে বাজারে বেঁচে তাই দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতে হয়। এভাবেই বিভিন্ন নদীর কিনারে শত শত নৌকায় নারী-পুরুষ, শিশুসহ শত শত মানুষের বসবাস। শিক্ষা, চিকিৎসা,খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত মান্তা সম্প্রদায়। মান্তা সম্প্রদায় জনগোষ্ঠীতে শিক্ষার হার নেই বললেই চলে। এর বড় কারণ হচ্ছে নদীতে ভাসমান জীবন কাটানোর ফলে এ সম্প্রদায়ের পড়াশোনা করা হয়ে ওঠে না। এছাড়াও অভাব-দরিদ্রতা তাদের শিক্ষা বিমুখ করে রেখেছে। তবে বর্তমানে নতুন প্রজন্মের অনেকে শিশু পড়াশোনার চেষ্টা করছে। অসুখ-বিসুখে মান্তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগে মান্তারা সবচেয়ে বেশি ভোগে। নদীদূষণের সরাসরি প্রভাব পড়ছে এই সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close