বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩

ভয়ংকর রোহিঙ্গা ক্যাম্প

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ১৯৭০ সাল থেকেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয়স্থল গড়ে তোলে রোহিঙ্গারা। এদেশের সীমান্তবর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্র ও উগ্র রাখাইনদের অমানবিক ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা এদেশে আশ্রয় নেয়। আর মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ ও ’৭৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আশ্রয় দিয়েছে। তবে এখন আর এদেশের ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চায় না সরকার। সূত্রমতে, ১৯৭০ সাল থেকে কখনো ৫০ হাজার, কখনো ২ লাখ, আবার কখনো কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে এদেশে। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র রাখাইন সন্ত্রাসীদের হামলা এবং গণহত্যার ঘটনায় প্রায় ৮ লাখের অধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে নতুন পুরোনো মিলে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে।

পাশাপাশি কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আরো রয়েছে অন্তত লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভাসমান জীবন-যাপন। কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। পরিবেশের পাশাপাশি এখন আইনশৃঙ্খলার বারোটা বাজতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জঙ্গি তৈরি, অপহরণ, মাদক, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজিতে ভয়ংকর পরিস্থিতির। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের এদেশের অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বাস করে আসছে।

হঠাৎ মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে। আর মানবিক কারণে সরকার আশ্রয় দিলেও বর্তমানে প্রত্যাবাসনে বিন্দু পরিমাণও অগ্রগতি দেখছি না। হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক চাপ ও কয়েকটি সংস্থার মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অনেক আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকের জের ধরে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরও হয় এবং একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপও গঠন করা হয়। সমঝোতা স্মারকে দুই পক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে। এই সিদ্ধান্তের অনুকূলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে। কিন্তু বাস্তবে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।

এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি খুবই ভয়ংকর বলে দাবি করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আধিপত্য বিস্তার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জঙ্গি তৈরি, অপহরণ, মাদক, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজিতে দিনাতিপাত করছে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা। পাশাপাশি আতংকিত স্থানীয় বাসিন্দারাও। কারণ কখন কী ঘটে যায় এটা বলা যাচ্ছে না। সন্ধ্যা নামলেই ক্যাম্পে নেমে আসে আতঙ্ক। চলে গোলাগুলি আর অস্ত্রের মহড়া। নিত্যনতুন সৃষ্টি হচ্ছে সন্ত্রাসী গ্রুপ। সব মিলিয়ে অপরাধ বাড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের সূত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, আধিপত্য বিস্তারের জেরে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের বর্তমান সময় পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১২৮টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোহিঙ্গা মাঝি জানান, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সক্রিয় ছোট বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে শতাধিক। এ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর একেকটিতে আবার সদস্য রয়েছে সর্বনিম্ন ৪০/৫০ জন থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ জন পর্যন্ত। এই গ্রুপগুলোর ছোট বড় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, অপহরণসহ ১২ ধরনের অপরাধ করছে এরা। পাশাপাশি ক্যাম্পে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং জানান দিতে সর্বদা খুনসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর পাশাপাশি সক্রিয় মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোও। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামি মাহাজ এবং জমিয়াতুল মুজাহিদিনের পাশাপাশি নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে আরো কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন।

তার মধ্যে সোমবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে উখিয়ার কুতুপালং ৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লকের আশপাশে কক্সবাজারস্থ র‌্যাব-১৫ এর সাথে গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। এ সময় র‌্যাবের হাতে আটক হয় এই জঙ্গি সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান ও শূরা সদস্য মাসিকুর রহমান মাসুদ ওরফে রনবীর এবং তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ আবু বাশার। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ৩টি অস্ত্র ছাড়াও ৩টি ম্যাগজিন, ১১২ রাউন্ড গুলি ও নগদ আড়াই লাখাধিক টাকা। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের জানান, র‌্যাবের ধারাবাহিক অভিযানে গোয়েন্দা তথ্য ছিল নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সামরিক শাখার প্রধান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মগোপনে রয়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার ভোরে কুতুপালং ৭ নম্বর ক্যাম্পের এ ব্লকে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এ সময় র‌্যাবের অবস্থান বুঝতে পেরে জঙ্গিরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতাসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টির পাশাপাশি অপরাধপ্রবণতা বাড়ার কথা স্বীকার করে কক্সবাজারের উখিয়ার ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত ডিআইজি ছৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ক্যাম্পে হঠাৎ জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। ক্যাম্পের পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে। তবে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close