মিরাজুল ইসলাম মিরাজ, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা)

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

খেজুর গুড়ের হাট

খেজুর গুড়ের লোভনীয় স্বাদ ও গন্ধ শীতের মৌসুমকে দিয়েছে অন্যরকম মর্যাদা। এই খেজুর গুড়ের পিঠাপুলি আর জিবে জল আনা নানা উপাদেয় খাবারের দিকে বরাবরই আলাদা আকর্ষণ বাঙালির। এই ভরা শীতে যখন সারা দেশ কাঁপছে, তখন চুয়াডাঙ্গা জেলায় জমে উঠেছে দুইটি ঐতিহ্যবাহী গুড়ের হাট। ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ হাট এবং শতবর্ষী জয়রামপুর হাট এখন নলেন গুড় আর পাটালি গুড় ব্যবসায়ী-দোকানি আর আড়তদারের হাঁকডাকে মুখর। সরোজগঞ্জ হাট বসে সপ্তাহের প্রতি শুক্র ও সোমবারে আর জয়রামপুর গুড়ের হাটটি বসে শনি ও মঙ্গলবারে।

শনিবার সকালে হাট চত্বরে আসতেই চোখে পড়ে সারি সারি সাইকেল, আলমসাধু, নছিমন-করিমন ও কলসিভর্তি খেজুর গুড়। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘আজ জয়রামপুর গুড়ের হাট। দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর স্টেশন গুড়ের হাটটি জেলার শতবর্ষের পুরোনো হাট। এছাড়া দেশের সর্ববৃহৎ গুড়ের হাটটিও বসে এ জেলার সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। জেলার এই দুটি হাট বসে ভোর থেকে। সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, হাটের পুরো এলাকাজুড়ে গাছিরা গুড়ভর্তি মাটির কলস (ভাঁড়) নিয়ে এসেছেন। নলেন গুড়ের গন্ধে মণ্ডম সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রেতা (মূলত গুড় ব্যাপারী) হাতে থাকা লোহার শিক দিয়ে গুড় ও পাটালি ভেঙে মুখে পুরে পরীক্ষা করছেন। দরদাম ঠিক হলেই গুড়ের কলসগুলো মাঠের একপাশে নিয়ে ওজন করে সাজানো হচ্ছে। ওজন করার পর প্রতিটি কলসের গায়ে সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার খেজুর গুড়ের সুনাম দেশজুড়ে, এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এখানকার নলেন পাটালি স্বাদে গন্ধেও অতুলনীয়। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ব্যাপারীরা। এবারও আসছেন।

গত মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে প্রায় দুই কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হলেও চলতি মৌসুমে বছর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় সপ্তাহে প্রায় আড়াই কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হচ্ছে বলে জানান পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মৌসুমের প্রায় পুরোটা সময় হাজারো ক্রেতাণ্ডবিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে হাট।

চুয়াডাঙ্গার বেলগাছি গ্রামের মোতালেব বিশ্বাসের ছেলে আলাউদ্দীন বিশ্বাস জানান, এবার তিনি ২০০ গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেছেন। এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাসিক বেতনে একই গ্রামের সাইফুল গাছিকে কাজে রেখেছেন। এ মৌসুমে তিনি প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার পাটালি ও গুড় বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তার দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হবে।

সরোজগঞ্জ বাজার কমিটির সাবেক সভাপতি এম আবদুল্লাহ শেখ জানান, এ হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয় গুড়। চলতি মৌসুমে প্রতি হাটের দিন গড়ে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কলসি (বড় ভাঁড়) খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে। এর মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। তিনি দাবি করেন, সরোজগঞ্জ হাটে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ গুড়ই এলাকার কৃষকরা বাড়িতে যত্নের সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা রাসায়নিক কিছু নেই। এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি।

দামুড়হুদার উপজেলার জয়রামপুর স্টেশন গুড়ের হাটের ইজারাদার আয়ুব আলী স্বপন জানান, প্রতি হাটে প্রায় ৪০০-৫০০ গাছি গুড় নিয়ে আসেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় শতাধিক ব্যাপারী এসে গুড় কিনে নিয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, এখানে ব্যাপারীদের থাকার ব্যবস্থা আছে। এই হাটে সপ্তাহে দুই দিনে কোটি টাকার গুড় বিক্রি হয়ে থাকে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত মৌসুমের তুলনায় চলিত মৌসুমে জেলার চার উপজেলায় ১৬ হাজার নতুন খেজুরগাছ থেকে গাছিরা রস সংগ্রহ করছেন। এবারের মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৬৬ হাজারের মতো খেজুরগাছ থেকে গাছিরা রস আহরণ (সংগ্রহ) করছেন। এর প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে গুড়ের মৌসুম। এ মৌসুমে গড়ে আড়াই হাজার টন গুড় উৎপাদিত হবে।

এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা জানান, মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসেবে চলতি মৌসুমে গড়ে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টন গুড় উৎপাদিত হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close