সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
ভাবনায় বেগম রোকেয়া
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আলোকশিখা হাতে নিয়ে বাঙালি নারীদের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনিই বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে প্রথম কলম ধরেন সব কুসংস্কার থেকে নারীকে মুক্ত করতে। নারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করার জন্য তার ছিল নিরলস পরিশ্রম। বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত কালজয়ী মহীয়সী এই নারীকে নিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীদের ভাবনা।
নারী শিক্ষার অনুপ্রেরণা ও স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়া
ইসরাত জাহান টুম্পা, গণিত বিভাগ
‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্র দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সেলাই করিবার জন্য মাপেন...।’ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আর ধর্মীয় গোড়ামিপূর্ণ এক অন্ধকার সময়ে যে আক্ষেপ থেকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী-পুরুষের এই তুলনা করেছিলেন তার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে নারীরা পুরোপুরি পুরুষের সমকক্ষ না হলেও বালিশের দৈর্ঘ্য প্রস্থ পরিমাপের গ-িতে আর আবদ্ধ নেই তা বেগম রোকেয়ার সেই আক্ষেপের কিছুটা হলেও অবসান ঘটায়। নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শত প্রতিকূলতার মাঝেও নারী শিক্ষায় শ্রম দিয়েছেন। সে শ্রম বিফলে যায়নি। তার উজ্জ্বল উদাহরণ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমত রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরে অবস্থিত। পাশাপাশি রোকেয়ার নামে হওয়াতে এখানে অধ্যয়নরত নারী শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক এগিয়ে থাকবেন- এটি সবার কাম্য। বাস্তবতাও কিন্তু ঠিক তাই বলে। বেগম রোকেয়া একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমান তালে চলবে। সেই স্বপ্ন পূরণে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষার্থীরা বেগম রোকেয়াকে ধারণ করুক, লালন করুক- এই প্রত্যাশা।
‘অবরোধবাসিনী না হয়ে সুলতানার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই হোক তাদের মূলমন্ত্র’
পোমেল বড়ুয়া, লোক প্রশাসন বিভাগ
নারীশিক্ষা, নারী জাগরণ, নারীর স্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। অন্ধকার পথ থেকে বের হওয়ার জন্য তিনি একাই চলেছেন আলোকশিখা হাতে। মুসলমান সমাজের অনগ্রসর যুগে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল একক ব্যতিক্রমী ও অনন্য সাধারণ। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ না থেকে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হোক আমাদের নারীরা। আমাদের অবরোধবাসিনী না হয়ে সুলতানার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই হোক তাদের মূলমন্ত্র। প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে জন্ম হোক রোকেয়ার মতো মহীয়সী নারীর। উন্মোচিত হোক সহস্র সম্ভাবনার দ্বার। এক্ষেত্রে বেরোবি হয়ে উঠুক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
‘নারী শিক্ষার অগ্রদূতের প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষা কত দূরে’
নিশাত তাসনিম, সমাজবিজ্ঞানী বিভাগ
‘নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় নারী শিক্ষা শুরু হয়। তার সমসাময়িক সময়ে নারী শিক্ষা ছিল না বললে ভুল হবে না। তখন নারীদের জীবন ছিল চার দেয়ালে বন্দি। অদম্য আশা নিয়ে নারী শিক্ষা বাস্তবায়নে তিনি বাড়ি বাড়ি ছাত্রী সংগ্রহ করার জন্য ঘুরেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, নারী শিক্ষা বর্তমানে তার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কতটুকু এগিয়ে? আমরা কি তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে নারীর সংযোগ কি ঘটাতে পেরেছি? আমরা এখনো শতভাগ নারী শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি মাত্র। তার স্বপ্ন এই একুশ শতকে এসেও বাস্তবায়ন হয়নি।
শুধু নীতি প্রণয়ন করে নারীদের শতভাগ শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব নয়। এই নীতিকে কার্যকর করে প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শুরু করে শহর অঞ্চলের প্রতিটি নারী যাতে শিক্ষিত, জাগ্রত, মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক হয়ে নব্য বেগম রোকেয়া হিসেবে গড়ে উঠে সেদিকে লক্ষ্য রেখে, বর্তমান শিক্ষায় শতভাগ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
উন্মুক্ত হোক বেগম রোকেয়াকে জানার পথ
মো. গোলাম জাকারিয়া, ইতিহাস প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
‘নারী অবহেলিত-উপেক্ষিত, নারী সমাজের বোঝা। তারা থাকবে শুধু ঘরের মধ্যে, বাড়ির কাজ সামলাবে। কেন বাহিরে যাবে?’- এসব কথা শুধুই অতীত। নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এই অন্ধকার থেকে নারীদের বাইরে নিয়ে এসেছেন। তিনি স্বশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি মনোযোগ দিয়েছেন নারীদের উন্নয়নে। নারীরা এখন আকাশ থেকে মহাকাশ জয় করছে। তারা যেমন চুল বেঁধে ঘর সামলাচ্ছে ঠিক তেমনি তারা অফিসের কাজ সামলাচ্ছে। নারীর এই জাগরণের মূলে রয়েছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি ছিলেন একাধারে সংগঠক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানমনস্ক। নিজ উদ্যোগে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নারী শিক্ষার জন্য স্কুল। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের শিক্ষার জন্য আগ্রহী করে তোলেন। তিনি তার লেখনির মধ্যে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।
এই মহান মহীয়সী নারী রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তার নামে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তার নামে ২০০৮ সালে রংপুর বিভাগে গড়ে ওঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রোকেয়া সাখাওয়াত নামে বিষয় চালু করবে। সব স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য রোকেয়াকে জানার পথ উন্মুক্ত হোক। আমরা বেগম রোকেয়াকে জানব, ধারণ করব তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুলো।
‘বেগম রোকেয়া নারী পশ্চাৎপদতা উত্তরণের পথিকৃৎ’
তমালিকা রায়, গণিত বিভাগ
কুসংস্কারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারীদের মাঝে আলো নিয়ে এসেছিলেন মহীয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারীর বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। যা পরবর্তী সময়ে নারীদের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পাথেয় হয়েছিল। তিনি যে শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন তা শুধু পুঁথিগত অক্ষর জ্ঞান নয় বরং যে শিক্ষা প্রকৃত জ্ঞানকে জাগ্রত করে বুদ্ধির বিকাশ ঘটায় এবং সমাজ উন্নয়নে কাজ করে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী এগিয়েছে, হয়েছে আত্মনির্ভরশীল। নারীর উন্নয়নে অবদানের কারণে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন বেগম রোকেয়া। তিনি আমাদের প্রেরণা, নারী মুক্তির পথিকৃৎ।
"