মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের, (বাঁশখালী) চট্টগ্রাম

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০২২

ইটভাটায় অবৈধভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ

উজাড় হচ্ছে বন * নীরব ভূমিকায় বাঁশখালী প্রশাসন

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ইটভাটায় অবৈধভাবে দিন-দুপুরে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে পরিবেশ। সরকারি নিয়মণ্ডনীতি না মেনে ভাটাগুলোতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানো হলেও প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।

নির্দিষ্টভাবে ১২০ ফুট চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও দু-একটা ছাড়া অধিকাংশ ইটভাটা সেই নিয়মও মানছে না। গত বছর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে আর্থিক জরিমানা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব ইটভাটা আবারও চালু করা হয়। এতে পরিবেশ নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন হলেও এই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ১১টি ইটভাটা রয়েছে।

তার মধ্যে পুকুরিয়া ইউনিয়নের চা-বাগান সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে জিকজ্যাগের পরিবর্তে গড়ে তোলা হয়েছে লম্বা চিমনির মেসার্স চৌধুরী ব্রিক নামের ইটভাটা। তা ছাড়া সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি ভাটা। একইভাবে বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে দুই কিলোমিটারের ব্যবধানে কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে তিনটি ইটভাটা, চাম্বল-বড়ঘোনা সড়কের পাশেই লোকালয়ে একটি ও শেখেরখীল-ছনুয়া সড়কে একটি। অন্যদিকে বাঁশখালী সাতকানিয়া সীমান্তের চূড়ামণি এলাকায় দুটি ইটভাটা রয়েছে। বাঁশখালীর বাহারছড়ায় তিনটি ভাটার মধ্যে একটিতে ১২০ ফুট চিমনি থাকলেও অন্য দুটিতে পুরোনো আমলের ড্রাম চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

উপজেলার সরল ইউনিয়নের মিনজিরতলা গ্রামের পশ্চিমে একটি কৃষিজমির মাঠে ইটভাটাটি স্থাপন করা হয়। এ ভাটায় প্রতি বছর নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট তৈরি করা হয়। এখানে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ লাখ ইট উৎপাদন করা হয়। ভাটাটিতে আধুনিক পরিবেশবান্ধব জিগজ্যাগ চিমনি ব্যবহার করা হয়নি। সনাতন পদ্ধতির ড্রাম চিমনি দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। ড্রাম চিমনি দিয়ে ইট পোড়াতে কাঠের প্রয়োজন। অন্যদিকে কাঠ চেরাইয়ের জন্য উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটার আশপাশে করাতকল স্থাপন করা হয়েছে। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করায় ইট পোড়ানোর মৌসুমে প্রচুর বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। এতে আশপাশের জমিতে ধানের আবাদ ও এলাকার ফলদ গাছপালার উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এতে পরিবেশের চরম বিপর্যয় হচ্ছে বলে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন ছাড়াই এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে তিন কিলোমিটারের দূরতে কৃষিজমিতে রয়েছে তিনটি ভাটা। রত্নপুরে গত ৪-৫ বছর আগে গড়ে উঠেছে আরো একটি ভাটা। এসব ইটভাটা লাগোয়া কয়েক গ্রামে হাজার মানুষের বসবাস। স্থানটি কোনোভাবেই ইটভাটা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত নয়। ইট পোড়ানোর ফলে এই এলাকার জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি আশপাশের বনাঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একবার ইট পোড়াতে প্রায় চার হাজার মণ কাঠ পোড়াতে হয়। এসব কাঠ জোগাড় হচ্ছে আশপাশের সংরক্ষিত বন থেকেই। ফলে উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ইটভাটা গড়ে উঠলেও তা নিয়ে কারও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।

এসব অবৈধ ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। একটা সময় এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। পরিবেশ দূষণ করে ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে যারা এভাবে ইটভাটা গড়ে তুলছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ আইন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন আরো কঠোর করা ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

অবৈধ ইটভাটার মালিকরা দাবি করেন, তাদের পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়ে ভাটা চালু রাখতে হয়েছে। অবৈধ ভাটা চালু রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তারা বলেন, শুরুতে তারা ড্রাম চিমনি পদ্ধতির ভাটায় ইট পোড়াতেন। পরে সরকার ১২০ ফুট উঁচু চিমনি দিয়ে ইটভাটা তৈরির নির্দেশনা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশির ভাগ ইটভাটা ১২০ ফুট উঁচু চিমনিতে রূপান্তরিত করা হয়।

সবশেষ সরকার নতুন এক নির্দেশনায় জিগজ্যাগ কিলন, হাইব্রিড কিলন, ভারটিক্যাল স্যাফট কিলন, টানেল কিলন পদ্ধতিতে ইটভাটা প্রস্তুতের নির্দেশনা জারি করে। তবে তারা সেই নীতিমালা মানছে না। কারণ এরই মধ্যে সব ভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত চলবে ইট পোড়ানো। এরপর মাত্র তিন মাসে কোনো অবস্থায়ই ভাটা রূপান্তরিত করা যাবে না। কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর ফলে দিন দিন বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ছে বনাঞ্চল। একটি গ্রুপ পাহাড়ি মাটি কেটে ভাটাগুলোতে সরবরাহ করছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে।

এদিকে পাহাড় থেকে মাটি কেটে ভাটায় নিয়ে আসার ফলে দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে পাহাড়ি ভূমি। ভাটাগুলোতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ইটভাটার মালিকরা কয়লার সংকটের কারণে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দাবি করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ কয়লার চেয়ে কাঠের দাম কম হওয়ায় ভাটাগুলোতে প্রতিনিয়ত বেপরোয়াভাবে পোড়াচ্ছে অবৈধ কাঠ।

চাম্বল বনবিট কর্মকর্তা শেখ আনিসুজ্জামান বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ভাটাগুলোতে পাহাড় কাটা মাটি ও কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণভাবে নিষেধ রয়েছে। তবে পরিবেশবান্ধব নিয়ম অনুসারে ইটভাটা হলে বনবিভাগের কোনো আপত্তি নেই। যেসব ইটভাটা পরিবেশবান্ধব নিয়ম না মেনে পাহাড়ি মাটি বা কাঠ ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে কেউ যাতে পাহাড় থেকে মাটি ও বন থেকে কাঠ না কাটে সেজন্য কঠোরভাবে নজরদারি চলছে। নিয়মবহির্ভূত কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কয়েক বছর আগে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি উপজেলায় অভিযান চালাতে গিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অবরোধের মুখে পড়েন। সে যাত্রায় আর অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। অভিযান না চালানোর জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের চাপও রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব ইটভাটা তৈরিতে কোনো বাধা নেই। পাহাড় থেকে কাটা মাটি দিয়ে ও কাঠ পড়ানোর কোনো নিয়ম নেই। যদি কেউ এই নিয়ম না মেনে চলে তদন্ত করে তাদের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close