এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২২

পলোর নামে গ্রাম

গ্রামের নাম বোকাইল। ফরিদপুরের সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নে গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামের পরিবারের সংখ্যা দেড় শতাধিক। গ্রামের সবাই মাছ ধরার পলো তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বছরজুড়ে পলো তৈরি করে চলে তাদের জীবন। এভাবে চলছে যুগের পর যুগ। চার যুগেরও বেশি সময় ধরে গ্রামটিতে চলছে এ পলো তৈরির কাজ। যার কারণে গ্রামের আদি নাম বোকাইল বদলে হয়েছে পলোডাঙ্গা গ্রাম। গ্রামবাসীর উৎপাদিত পলোর নামেই এখন গ্রামটির নাম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামের প্রতিটি পরিবারের শিশু-কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধসহ সবাই পলো তৈরির কাজ করে থাকেন। এই পলোডাঙ্গা গ্রামের পলো ও খ্যাতি জেলার গ-ি পেরিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাইকারি দরে পলো কিনে বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় করে থাকেন। মাছ ধরার কাজেই শুধু এই পলো ব্যবহৃত হয় না। হাঁস-মুরগি পালন বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনেও এই বাঁশের তৈরি ছোট ছোট পলো তৈরি করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের বোকাইল গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়িতে পলো তৈরি করা হয় না। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় দেখা মেলে পলো ও পলো তৈরির জিনিসপত্র। বাঁশের শলা দিয়ে পলো তৈরির কাজ চলছে। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ বাঁশের শলা তৈরি করছেন আবার কেউ প্লাস্টিকের রশি দিয়ে তৈরি করছেন পলো। গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারের মানুষের দৈনন্দিন কাজই হচ্ছে পলো তৈরি করা। আর এভাবেই বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে এই পলো তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে এ গ্রামের মানুষ।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিটি পরিবারের তিন থেকে চারজন সদস্য গড়ে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ পলো তৈরি করে থাকেন। তবে পুরুষের থেকে বাড়ির নারীরাই সারা দিন পলো তৈরির কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। আশপাশের হাট-বাজারে বিক্রি করার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পলো ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাইকারি দামে পলো কিনে নিয়ে যান। বাজারে প্রকারভেদে প্রতিটি পলো ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর পাইকারি দরে প্রতিটি পলো ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। বড় আকারের একটি বাঁশ কিনতে খরচ পড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। প্রতিটি বাঁশ দিয়ে তিন থেকে চারটি পলো তৈরি করা যায়।

বোকাইল গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মোল্লা বক্কার মন্ডল ও ইদ্রিস শেখ বলেন, আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে এই পলো তৈরির পেশার সঙ্গে জড়িত। গ্রামের আদি নাম বোকাইল হলেও এখন সবার কাছে মৌখিকভাবে পলোডাঙ্গা গ্রাম হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। প্রতিটি পরিবারই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। পলো তৈরি করেই আমাদের জীবন চলে। তারা আক্ষেপ করে বলেন, সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আমরা পাই না। সুদমুক্ত সরকারি-বেসরকারি ঋণের সুবিধা পেলে আমাদের জন্য উপকার হয়। গৃহবধূ নারগিস বেগম ও স্বর্ণা বেগম বলেন, সারা দিন গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি পলো তৈরি করে থাকি। এই পলো বিক্রির টাকা দিয়েই চলে আমাদের সংসার। সরকারি সহায়তা পেলে পলো তৈরি করে গ্রামের মানুষ আরো স্বাবলম্বী হতে পারত।

গ্রামের বাসিন্দা জসিম মাতুব্বর বলেন, পূর্বপুরুষদের থেকে এই পলো তৈরির কাজ চলে আসছে। আমি গ্রাম থেকে পাইকারি দরে পলো ক্রয় করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করি। এছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে মহাজনরা এসে পলো কিনে গাড়ি ভরে নিয়ে যান। ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে পাইকারি কিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকি। গাড়ি ও শ্রমিক খরচ বাদে প্রতিটি পলোতে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ টাকার মতো লাভ হয়।

গ্রামের আরেক বাসিন্দা হাসেম মোল্লা বলেন, আমি সেই পাকিস্তান আমল থেকে পলো তৈরি করি। বাপ-দাদার পেশা তাই ধরে রেখেছি। কোনোমতে খেয়ে-পরে চলছে জীবন। সরকারি-বেসরকারি সব সাহায্য-সহযোগিতা থেকে আমরা বঞ্চিত। এলাকার জনপ্রতিনিধিরা শুধু ভোটের সময় খোঁজ নেয় আর সারা বছর কোনো খোঁজ থাকে না। আমাদের সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করলে এ পেশা আরো ভালোভাবে করা সম্ভব। এতে আমাদের জীবনযাত্রার মান আরো ভালো হবে।

স্থানীয় ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) শেখ ঝিলু বলেন, গ্রামটির প্রতিটি পরিবার এই পলো তৈরির সঙ্গে জড়িত। পলো তৈরি করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী গ্রামের গরিব ও দুস্থ পরিবারকে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়।

গেরদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আরিফ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, গ্রামটি পলো তৈরির জন্য বিখ্যাত। গ্রামটির ৯৫ ভাগ মানুষ পলো তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। এটা তাদের প্রধান পেশা। তিনি আরো বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী নিয়ম অনুসারে গরিব অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। সে অনুসারে ওই গ্রামের মানুষদেরও সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়। তারপরও যে কেউ আমার কাছে যেকোনো সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আসলে সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ফরিদপুরের উপমহাব্যবস্থাপক হ র ম রফিকউল্লাহ বলেন, ফরিদপুরের বোকাইল গ্রামের পলো গুণে-মানে বেশ ভালো। এখানকার পলোর খ্যাতি ও চাহিদা রয়েছে। বিসিক সব সময় এসব ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে। একাজে জড়িতদের ভালোমানের পলো তৈরিতে আগ্রহী করার পাশাপাশি পলো তৈরির কারিগরদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close