বিবিসি

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২২

ভিডিও কলে ব্ল্যাকমেইল

সতর্ক থাকার উপায়

কলকাতার বাসিন্দার এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোকের বাড়িতে এক দিন কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন। রাত ৯টা ৩৯ থেকে ২ মিনিটের মধ্যে একটা অচেনা নম্বর থেকে পর পর ভিডিও কল আসছিল ভদ্রলোকের হোয়াটস্অ্যাপ নম্বরে। অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় প্রথমে খেয়াল করেননি তিনি, তাই ফোন ধরতেও পারেননি।

৯টা ৪২ মিনিটে ‘হাই’ বলে একটা মেসেজ ঢোকে ভদ্রলোকের হোয়াটস্অ্যাপে। কল আসছিল যে নম্বর থেকে, এই মেসেজটাও একই নম্বর থেকে আসা। এবারে খেয়াল করেন তিনি। উত্তরে লেখেন, ‘আমি কি আপনাকে চিনি?’ জবাব আসতে দেরি হয়নি : ‘অনলাইন সেক্স করতে চাও?’

ওই ভদ্রলোকের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, যে অশ্লীল চ্যাটের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে তাকে। তিনি সেই প্রলোভনে অবশ্য পা দেননি। তবে বহু মানুষ যে ভুলটা করছেন, তাহলো অচেনা নম্বর থেকে আসা হোয়াটস্অ্যাপ বা ফেসবুক মেসেঞ্জারের ভিডিও কলটা রিসিভ করে ফেলে।

যে ভুলটা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দলের বর্ষীয়ান নেতা ও হুগলী জেলার চুঁচুড়া থেকে ১৫ বছরেরর বিধায়ক অসিত মজুমদার। সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে তার মোবাইলে একটা অচেনা নম্বর থেকে ভিডিও কল আসে। তিনি কলটা রিসিভ করে নিয়েছিলেন।

অসিত মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘কলটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্তে এক নারীর ভিডিও দেখা যায় যিনি তার পোশাক খুলছিলেন। মুহূর্তেই বুঝে যাই যে এটা একটা ফাঁদ। কলটা কেটে দিই।’ সেদিন পর পর বেশ কয়েকবার ওই একই নম্বর থেকে ভিডিও কল আসে, আর ধরেননি তিনি। পরের দিন অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন আসে। বলা হয় দিল্লি পুলিশ থেকে ফোন করা হচ্ছে এবং তাদের কাছে অসিত মজুমদারেরর সেক্স চ্যাটের ভিডিও আছে, যেটা তারা ভাইরাল করে দেবেন।

‘আমি তাদের নম্রভাবেই বলি যে হোয়াটস্অ্যাপে কল না করে সাধারণ কল করুন। তারা বারে বারে একই হুমকি দিতে থাকে। যিনি ফোনটা করছেন, তিনি যে পুলিশ অফিসার নন, সেটা আমি বুঝে গেছি, আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে লাভ হবে না।’

যেভাবে চলছে সেক্সটরশান : ‘যেহেতু আপনি ভিডিও কল রিসিভ করেছেন, তাই আপনার মুখটাও অপর প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেও আপনি যদি কলটা কেটে দেন, অন্য প্রান্তে কাজ হাসিল হয়ে গেছে,’ বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ সরকারী কৌঁসুলি বিভাস চ্যাটার্জী।

বিভাস চ্যাটার্জীর কথায়, ‘যিনি কলটা রিসিভ করলেন, তার মুখ তো চলে এলো। আর অন্যদিকে তো পর্নো ভিডিওর অভিনেত্রী আছেন। এই দুটোকে এডিট করে একটা এমএমএস বানাচ্ছে যা দেখে মনে হবে সত্যিই ওই ব্যক্তি অশ্লীল ভিডিও চ্যাট করছিলেন। তারপর সেটা এই ব্যক্তিকে পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে টাকা না দিলে এই ভিডিও পরিবার, বন্ধু, অফিসের সহকর্মীদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সামাজিক দুর্নামের ভয়ে বহু মানুষ টাকা দিতে শুরু করেন ওই ব্ল্যাক মেইলারদের।’

‘আর একবার যদি তাদের কথায় টাকা দিয়ে ফেলেন কেউ, তার কবল থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন,’ মন্তব্য সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্তর। বিশেষজ্ঞরা এই সাইবার অপরাধের নাম দিয়েছেন সেক্সটরশান বা সেক্স চ্যাটের নাম করে এক্সটরশান, অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইল করা। এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন মূলত মধ্যবয়সি প্রতিষ্ঠিত পুরুষরা।

কলকাতার এই সময় পত্রিকার সহকারী সম্পাদক চিত্রদীপ চক্রবর্তী একটা গবেষণাধর্মী বই লিখছেন এই সাইবার অপরাধ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘যারা এই কাজটা শুরু করে তারা কিন্তু বেশি শিক্ষিত নয়। অনেকে তো এই অপরাধটা পারিবারিক কাজ হিসেবেই চালায়। প্রথমে ওরা নানা কায়দায় হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর জোগাড় করত। সেখান থেকে ডিপিটা (প্রোফাইল ছবি) নিয়ে ওরা কোনো পর্নো ছবিতে সেটা সেট করে ব্ল্যাকমেইলটা করত তখন। ওরা দুটো সফটওয়্যার ব্যবহার করত। পরে যখন বহু মানুষ এভাবে প্রতারিত হয়ে ডিপি বদলে ফুল, গাছ, প্রাকৃতিক দৃশ্য লাগাতে শুরু করেন, তখন ওরাও কৌশল পাল্টায় আর এই এখন যেটা চলছে, সেভাবে ভিডিও কল করে প্রতারণাটা করছে,’ বলছিলেন চিত্রদীপ চক্রবর্তী। এরকমই একজন ধৃত পুলিশকে জানিয়েছিল যে সে একাই ১১ কোটি টাকা ব্ল্যাকমেইল করে রোজগার করেছে।

‘এরা যে বিষয়টার জেরে অপরাধটা চালিয়ে যেতে পারছে, তা হল মানুষের সম্মানহানির ভয়। এরা শিকার খোঁজে সমাজে কিছুটা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে, যে অংশটা সামাজিক সম্মান বাঁচানোর জন্য পরিবার বা পুলিশকে জানাতে হয়তো ভয় পাবেন। তাই খুব কম সংখ্যায় সেক্সটরশানের ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্টেড হচ্ছে,’ বলছিলেন সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ সরকারী কৌঁসুলি বিভাস চ্যাটার্জী।

বিভাস চ্যাটার্জী বলছেন, ‘ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে টাকা না দিয়ে পুলিশকে জানাতে হবে, যাতে যে অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটার সূত্র ধরে অপরাধীদের খোঁজ পাওয়া যায়।’

কী কী সাবধানতা নেওয়া দরকার : অচেনা নম্বর থেকে আসা কোনো রকম হোয়াটস্অ্যাপ ভিডিও কল অথবা অপরিচিত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আসা মেসেঞ্জার কল রিসিভ করবেন না। তবে অনেক সময়েই কাজের মধ্যে অন্যমনস্ক থাকি আমরা, তাই হয়তো খেয়াল না করেই কলটা রিসিভ করে ফেলি। তাই মোবাইলের সেলফি ক্যামেরার ওপরে একটা স্টিকার লাগিয়ে রাখুন। কোনোভাবেই যাতে আপনার মুখ না দেখা যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close