নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২১ নভেম্বর, ২০২২

বড় ক্ষতির মুখে সিরামিক খাত

বৈশ্বিক সংকটে এমনিতেই বাড়তি প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট, বাড়ানো হয়েছে জ্বালানির দাম। প্রভাব পড়েছে নির্মাণকাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান টাইলসের ওপর। মন্দা দেখা দিয়েছে টাইলস বিক্রিতে। এ খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, ছয় মাস ধরে ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছে। ক্রেতা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বিক্রি অর্ধেকে নেমে গেছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, বিক্রি ভালো না হওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী লোকসান গুনছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না। সবকিছু মিলে টাইলসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এক ধরনের সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। ফলে ব্যবসায়ী, কর্মীদের কারো মন ভালো নেই। কর্মীদের কেউ কেউ ছাঁটাই আতঙ্কেও ভুগছেন।

তবে বিক্রিতে ভাটা পড়লেও গত ছয় মাসে একাধিকবার টাইলসের দাম বেড়েছে। মান অনুযায়ী, সম্প্রতি টাইলসের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে সব থেকে বেশি বেড়েছে ছোট টাইলসের দাম। ছোট টাইলসের দাম ২০ শতাংশের ওপরে বেড়েছে। আর বড় টাইলসের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ।

জানা গেছে, দেশের সম্ভাবনাময় সিরামিক শিল্প এখন রপ্তানিমুখী খাত। গত কয়েক বছরে এই খাতটির অগ্রগতি অভূতপূর্ব। চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই মেটাচ্ছে দেশের সিরামিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। রপ্তানিতেও বেশ চাহিদা আছে বাংলাদেশে উৎপাদিত সিরামিক পণ্যের। তবে সম্প্রতি গ্যাস সংকটে খাতটির ওপর রীতিমতো নেমে এসেছে অশনিসংকেত। এলাকাভেদে দিনে শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা। অথচ সিরামিক কারখানার জন্য মেশিন ২৪ ঘণ্টা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রেখে চালু রাখা জরুরি। এতে রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে আসার পাশাপাশি দেশের চাহিদা মেটানোই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ময়মনসিংহের ভালুকায় টাইলস ও সিরামিকের তৈজসপত্রের আলাদা দুটি কারখানা গড়ে কুলেছে এক্সিলেন্ট সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। মার্চ মাস থেকে গ্যাস সংকটে গুনতে হচ্ছে লোকসান। হাতে প্রচুর বিদেশি ক্রয়াদেশ থাকলেও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় তা সরবরাহ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে এক্সিলেন্ট সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুুল হাকিম সুমন বলেন, এখনো ফ্যাক্টরিতে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না।

আমাদের মেশিনগুলো ২৪ ঘণ্টা কাজ করার পরিকল্পনা করে বসানো। উৎপাদন ৫০ শতাংশে নেমেছে। মেশিনের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। উৎপাদনের পরিকল্পনায় ব্যাংক লোন নেওয়া আছে। লাভ তো দূরের কথা, কীভাবে লোকসান কমানো যায় সেই চেষ্টা চলছে গত মার্চ থেকে। প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছি, চেষ্টা করছি রক্তক্ষরণটা কমানোর।

শুধু এক্সিলেন্ট সিরামিক নয়, গ্যাস সংকটে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে সামগ্রিক সিরামিক খাত। দেশের অভ্যন্তরে সিরামিকের বাজার ১০ হাজার কোটি টাকার। পাশাপাশি প্রতি বছর বিদেশে যাচ্ছে আরো পাঁচ শ কোটি টাকার সিরামিক পণ্য। চলতি বছর এ চাহিদা অব্যাহত থাকলেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে থমকে গেছে শিল্পটি। কারখানার উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশের বেশি কমাতে বাধ্য হয়েছেন উদ্যোক্তারা।

তারা জানান, গ্যাস সংকটে বাজারে ঠিকঠাক পণ্য দিতে পারছেন না। আবার রপ্তানি পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো ক্রয়াদেশ কমাচ্ছে। এতে সিরামিক রপ্তানিও নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। সার্বিকভাবে এ বছর খাতের টার্নওভার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমছে।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন বলেন, গ্যাসের কারণে আমাদের এ বছর তিন হাজার কোটির মতো টার্নওভার কমছে, যা সার্বিক বাজারের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এ ক্ষতির কারণে অধিকাংশ কোম্পানি লোকসানে পড়বে। বিশেষ করে ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।

এখন গ্যাসের সংকট কেমন জানতে চাইলে ইরফান উদ্দিন বলেন, অক্টোবর মাসে গাজীপুর এলাকার কারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ থাকত না। এখন ছয় ঘণ্টা থাকে না। সে কারণে গাজীপুর এলাকায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সাভারে এখনো কারখানা চলছে না। সেখানে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। নারায়ণগঞ্জেও এমন খারাপ অবস্থা। সেখানেও বড় ঘাটতি রয়েছে।

বিসিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে সিরামিক খাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। যার অধিকাংশ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায়। এসব কারখানায় সিরামিকের তৈজসপত্রের পাশাপাশি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ২০টি তৈজসপত্র, ৩২টি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের ১৮টি কারখানা চলমান। গত কয়েক বছরে এ খাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। যাতে একসময়ের আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের এখন প্রায় ৮০ শতাংশ দেশে তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি রপ্তানিও হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে ৫০টিরও বেশি দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের সিরামিকস পণ্য।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সিরামিকের যেসব পণ্য আছে, তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই টাইলস। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশের মতো স্যানিটারিওয়্যার। ১০ শতাংশ ডিনার সেট, টি সেট, মগ, বাটির মতো ক্রোকারিজ সামগ্রীর পণ্য। দেশে টাইলস উৎপাদনে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে বড় বাজারের ৯০ শতাংশ রয়েছে ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানির দখলে।

ঢাকায় সব থেকে বেশি টাইলসের প্রতিষ্ঠান রয়েছে হাতিরপুলে। এ অঞ্চলটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রাস্তার দুধারে তাকালেই চোখে পড়ে একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানে থরে থরে সাজানো বাহারি টাইলস।

হাতিরপুল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে তেমন ক্রেতা নেই। বেশির ভাগ সময় কর্মীদের অলস সময় পার করতে দেখা যায়।

বিক্রির অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তাজিম টাইলসের ম্যানেজার মো. রুবেল বলেন, ছয় মাস ধরে বিক্রির অবস্থা খুবই খারাপ। ছয় মাস আগে যেখানে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মাল (টাইলস) বিক্রি হতো, এখন সেখানে দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো দিন একজন ক্রেতাও পাওয়া যায় না, এমন ঘটনাও ঘটে। সবকিছু মিলে খুব খারাপ সময় পার করছি। আগে যে টাইলস ৩২ টাকা প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি করেছি, এখন তার দাম ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। সবকিছু মিলেই বিক্রি কম হচ্ছে।

বিক্রি পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন হোসেন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. আবুল হোসেনও। তিনি বলেন, করোনার ধকল না কাটতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নতুন সংকট তৈরি করেছে। বৈশ্বিক কারণে সব ধরনের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ক্ষেত্রে টাইলস খাতও বাদ যায়নি। আমাদের বিক্রি অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close