নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০২ অক্টোবর, ২০২২

নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ বাড়ছে

ঘটনার কোনো প্রতিকার পাননি মেয়েটি। ঘটনাটি ছিল গণপরিবহনের বাসে বাজে ইঙ্গিত। মেয়ে মানুষ, রাতের বেলায় বাসায় যাওয়ার চিন্তা করেন? বাসে উঠতে গিয়ে এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে চটে গিয়েছিলেন সাদিয়া সাকি (ছদ্মনাম)। তিনি তার বন্ধুদের ফোন করতে শুরু করেন। এসে বাসটি তাকে নামিয়ে দিয়ে চোখের পলকে চলে গেছে।

রোজ সাভার থেকে বসিলার এক বাসায় টিউশনে যেতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রী সাদিয়া। এক দিন টিউশন থেকে বেরিয়ে সাভারগামী বাসে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।

তিনি বলেন, এটি ২০২১ সালের ঘটনা। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আর আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফেরার প্রহর গুনছি। রাস্তায় বাস কন্ডাক্টর বাড়তি ভাড়া দাবি করায় প্রতিবাদ জানাই। এতে কন্ডাক্টরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। সাকি আফসোস করে বলেন, বন্ধুরা আসতে আসতে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেদিন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি।

কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি আবারও একটি লোকাল বাসে একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়ে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দেন। রাত প্রায় ৮টা বেজে গেছে। বাসওয়ালা বলল, ৮টার পরে স্টুডেন্ট ভাড়া নেবে না। এ নিয়ে খুব গ্যাঞ্জাম লাগল। আশপাশের লোকজন বলছিলেন আপা চুপ থাকেন। তখন আমি ৯৯৯-এ কল দেই। আমার থেকে তারা বাসের নম্বর নিল। এরপর বাসে হাফ ভাড়াই নেওয়া হয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে যে ধরনের ফোন আসে, সেই তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারীকে হয়রানি, নিপীড়ন, আর সহিংসতার অভিযোগ জানাতে বা সাহায্য চেয়ে ফোন কলের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে।

এ বছর আগস্ট পর্যন্ত এ ধরনের কল এসেছে ১৩ হাজার ৪১৬টি, যেখানে ২০২১ সালে পুরো বছর মিলে এমন কলের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ১৬৯টি।

আরো পেছনে তাকালে দেখা যায়, জরুরি সেবার এ হটলাইন চালু হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালে কোভিড মহামারি শুরুর পর নারীদের ফোন কলের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়। পরের বছর তা ফের দ্বিগুণ হয়ে ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

৯৯৯-এর কল সংখ্যা পর্যালোচনা করে পাওয়া এই তথ্য এ সংক্রান্ত পুরোনো জরিপের তথ্যকেও সমর্থন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, বিবাহিত নারী এবং মেয়েদের ৭০ শতাংশের বেশি তাদের পুরুষ সঙ্গীদের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে পীড়নের শিকার হয়েছেন। সেই জরিপের উত্তরদাতা অর্ধেক নারীই সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতারা বলেন, ৯৯৯-এ কল করে সহায়তা চাওয়ার মতো প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং মনোবল অনেক নারীর এখনো নেই। তাই অনেক সহিংসতার ঘটনা এখনো অভিযোগের খাতায় আসছে না।

নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশ থেকে গত পাঁচ বছরে ৯৯৯-এ যত কল এসেছে, তার মাঝে ১০ হাজার ২০৭টি ছিল অত্যাচার সংক্রান্ত। এর মাঝে ২০২২ এর প্রথম আট মাসেই এসেছে ৩ হাজার ৫৫২টি কল, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২৯২টি। গত পাঁচ বছরে শুধু স্বামীর হাতে নির্যাতনের অভিযোগই এসেছে ৯ হাজার ৩১৩টি। এর ৪৫ শতাংশই এসেছে এ বছরের প্রথম আট মাসে।

২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের ঘটনায় মোট কল এসেছে যথাক্রমে ৫ হাজার ৭৭০টি এবং ২ হাজার ৬৬৯টি। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড নিক্ষেপ এবং যৌতুকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। তারপরও এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়নি।

গত পাঁচ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় ৪০টি এবং যৌতুকের প্রতিকার চেয়ে ৮৬৩টি কল এসেছে ৯৯৯-এ। জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে এ বছর আগস্ট পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট কল এসেছে ৫৫ লাখ ১৫ হাজার ৯৯৪টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৯১ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৭টি। আর ২০১৭ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২২ এর আগস্ট পর্যন্ত মোট কল এসেছে ৪ কোটি ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৩৫টি। এসব কলের মাঝে ৫৯ দশমিক ২৫ শতাংশই ছিল ‘প্র্যাংক’ ও ‘ব্ল্যাংক’ কল।

যে কলাররা সত্যিই সেবা পেতে কল করেছিলেন, তাদের মাঝে পুরুষের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে শিশু এবং সবচেয়ে কম কল করেছেন নারীরা।

জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ‘অপরাধ বাড়ছে কি না (এই সংখ্যা থেকে) তা বলা যাচ্ছে না। সচেতনতা বাড়ছে কি না সেটাও বলা যাচ্ছে না। তবে এটা বলা যায়, ৯৯৯-এর প্রতি আস্থা বাড়ছে। যে কারণে মানুষের মাঝে এটি ব্যবহার করার প্রবণতাও বাড়ছে। সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ফোকাল পয়েন্ট থেকে বলা হয়েছে, ১৬২৬৩ (স্বাস্থ্য সেবা) অথবা ৩৩৩ (খাদ্য সহায়তা) তে ফোন দিন। কিন্তু তারপরও ৯৯৯-তে যে সংখ্যক কল এসেছে, তা মানুষের বিশ্বাস থেকেই এসেছে।

কোভিড সংক্রমণ শুরুর দুই মাস অর্থাৎ মার্চ ও এপ্রিলে ৯৯৯-এ সবচেয়ে বেশি কল এসেছে। ২০২০ এর মার্চে ১০ লাখ ২৯ হাজার ২৯৬টি এবং এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ৫ হাজার ৭১২। এরপর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।

৯৯৯-এর পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশি সহায়তা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ৯৯৯ থেকে কলারকে কল করা হয়, সমস্যার সমধান হয়েছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়। এসব কারণেই হয়ত মানুষ আমাদের ওপর ভরসা পাচ্ছে। কিন্তু সেজন্য অপরাধ বাড়ছে এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। একটা ভালো দিক যে, এখন একটা মেয়ের অভিযোগ করার জায়গা আছে। তার পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন দাঁড়াচ্ছে। এত দিন ধরে আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের ক্ষমতা তো রাষ্ট্রের মতো না। আমাদের সবসময়ই দাবি ছিল রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলো যেন এগিয়ে আসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close