ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ)

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বিএমডিএর প্রকল্পের ফাঁদে কৃষক কাঁদে

বরেন্দ্র অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক ও গভীর নলকূপের মেকানিক শহিদুল ইসলাম। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) প্রকৌশলীদের পরামর্শে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে বন্ধক নেওয়া প্রায় এক বিঘা জমিতে ঔষধিগুণসম্পন্ন সুপার ফুটখ্যাত নতুন বিদেশি ফসল চিয়াবীজের চাষ করেছিলেন। খেতের মধ্যে ‘উচ্চমূল্য মাঠ ফসল চাষাবাদ প্রদর্শনী’ নামে সাইনবোর্ড স্থাপন করে বিএমডিএ। রোগবালাই-পোকামাকড়ের ব্যাপক আক্রমণ ও আবহাওয়ার তারতম্যে এক টাকার ফসলও ঘরে তুলতে পারেননি তিনি।

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার প্রধানকুন্ডি এলাকার কৃষি উদ্যোক্তা মো. কামরুল হাসান চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে ৪৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেন রায়ান এগ্রো ফার্ম। বিএমডিএর বদলগাছী জোনের প্রকৌশলীর বিনা মূল্যে দেওয়া প্রায় এক কেজি চিয়াবীজ গত ১০ ডিসেম্বর এক বিঘা জমিতে বপন করেন। এতে ব্যাপক ছত্রাকের আক্রমণ হয়। কেউ কোনোই পরামর্শ দিতে পারেননি। প্রতি বিঘায় তিন থেকে চার মণ ফলন পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন মাত্র ২০ কেজি। বিএমডিএর প্রকৌশলীরা তার কাছ থেকে ১৫ কেজি চিয়াবীজ ৫০০ টাকা কেজি দরে কিনে নেয়।

নওগাঁ সদরের ভবানীগাঁথী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-সংলগ্ন মাঠে ওই গ্রামের এক কৃষক প্রায় ১৫ কাঠা জমিতে প্রকল্পের আওতায় বিদেশি সবজি বীনস চাষ করেন। ফলন হয়েছিল ৫-৬ মণ। সবজিটি বিক্রির জন্য কয়েকবার স্থানীয় হাটবাজারে নিয়ে গিয়ে হতাশ হন তিনি। ক্রেতা না থাকায় ফসল বিক্রি করতে পারেননি তিনি।

এ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকেই। ১৭ কোটি ৩৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে চাষিরা সর্বস্বান্ত হলেও কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হয়েছে বলে অভিযোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আবহাওয়াকে বিবেচনায় না এনে যথেষ্ট গবেষণা ও সম্ভাব্য যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত ও ছবি বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে ম্যানুয়াল প্রকাশ করে দায় সেরেছেন। প্রকল্প কর্মকর্তাদের অধিক লোভের শিকার হয়েছেন বলে ক্ষোভ চাষিদের। একে সরকারি অর্থ অপচয় ও অনিয়মণ্ডদুর্নীতির কৌশল হিসেবেই দেখছেন সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞরা।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৌশলীদের দিয়ে চাষাবাদবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করে বিস্তর গবেষণা ছাড়াই নতুন বিদেশি ফসল কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা।

বিএমডিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য মতে, নওগাঁ সদর, নিয়ামতপুর, বদলগাছী, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, সাপাহার, পোরশা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, গোমস্তাপুর, নাচোল, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও পবা উপজেলায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চমূল্য অপ্রচলিত ফল ও ঔষধি ফসল চাষাবাদ জনপ্রিয়করণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজশাহী। ২০২০ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের জুনে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকের ব্যক্তিগত জমিতে অথবা বাড়ির আশপাশে উচ্চমূল্যের অপ্রচলিত ফল ও ঔষধি ফসলের বাগান সৃজনের লক্ষ্যে বিনা মূল্যে ৪ লাখ ১৫ হাজার চারা, দুই হাজার কেজি বীজ বিতরণ, ৫২টি প্রদর্শন খামার স্থাপন, এক হাজার ৫০০ জন কৃষক এবং ৩০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৭৫ হাজার ৫২৩টি চারা, ৮০২ কেজি বীজ ক্রয়, ছয়টি প্রদর্শনী, ৪২০ জন কৃষক ও ৯০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চারা উৎপাদন, রোপণ ইত্যাদি কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিএমডিএ।

প্রকল্পের আওতায় উচ্চমূল্য অপ্রচলিত ফল ও ফসলের চাষাবাদণ্ডসংক্রান্ত ম্যানুয়াল প্রকাশ করেছে বিএমডিএ। সেখানে চিয়াবীজ, বীনস, মিসরি দানা, থাই সুপার ফাস্ট কাঁঠাল, পার্সিমন, আলুবোখরা, এলাচ, কাস্টার্ড আপেল, এভোগাডোসহ ৩৪টি বিদেশি নতুন ফসলের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। চিয়াবীজ ও বীনস চাষাবাদের বিষয়ে সার-কীটনাশক প্রয়োগ, রোগবালাই-পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধ, পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহের বিষয়ে কোনোই আলোচনা করা হয়নি। তথ্য-উপাত্ত ও ছবি বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে ম্যানুয়ালটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে বইটির শুরুতে উল্লেখ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ মতামত ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ছাড়াই ইন্টারনেট থেকে বিদেশি ফলের ছবি সংগ্রহ করে চাষাবাদের ম্যানুয়াল প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। এটি কৃষকের সঙ্গে প্রতারণার শামিল বলে মন্তব্য তাদের। চিয়াবীজ নিয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ডক্টর মো. মশিউর রহমান। জানতে চাইলে তিনি জানান, এটি রবি মৌসুমের ফসল। বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা ১৬-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস চিয়া চাষের জন্য উত্তম। প্রকল্প পরিচালককে তিনি ১৫ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) বীজ বপন করার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা ডিসেম্বর মাসের শেষে প্রদর্শনী প্লটে বীজ বপন করেন। অসময়ে চাষাবাদ করায় প্রকৃতিতে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে চিয়াবীজ চাষে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন এই কৃষি গবেষক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে কর্মরত ১০-১২ জন কৃষিবিজ্ঞানী জানান, প্রকল্প নেওয়ার আগে ভালোমতো স্টাডি করতে হয়। সবকিছু বিবেচনা করতে ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্য যাচাই) ভালো হতে হবে। অথচ দায়সারা ফিজিবিলিটি স্টাডি করে কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে লুটপাটের উদ্দেশ্যে এমন ভুতুরে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এতে কৃষকের ক্ষতি হলেও কর্মকর্তাদের পকেটের উন্নয়ন হচ্ছে। প্রকৌশলীদের দিয়ে চাষাবাদবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন অযৌক্তিক। নতুন বিদেশি ফসল চাষাবাদ ও সম্প্রসারণের আগে স্থানীয়ভাবে বাজার সৃষ্টি ও বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন বলেও জানান বিজ্ঞানীরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কর্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ জানান, চিয়াবীজ উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন অত্যন্ত লাভজনক ফসল। বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করলে কৃষক লাভবান হবেন। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আফরিনা পারভীনসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি বিভাগে কর্মরত ২০-২৫ জন কৃষিবিদ ও মাঠপর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা জানান, চিয়াবীজ ও বীনস সবজির বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। এসব ফসল সম্প্রসারণে সরকারিভাবে তাদের কাছে কোনোই নির্দেশনা নেই।

প্রকল্প এলাকার দেবীপুর নীচপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম, তসলিম উদ্দিনসহ ১০-১২ কৃষক জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। অপরিকল্পিত সরকারি প্রকল্পে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে প্রকল্পটির পরিচালক (পিডি) এটিএম রফিকুল ইসলাম জানান, এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন; ক্ষতির কিছুই নেই। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শহিদুলকে এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ অন্যান্য ফসল উৎপাদন হয় বাজার মূল্যের সমপরিমাণ টাকা তাকে দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রকৌশলীদের দিয়ে চাষাবাদবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের সদুত্তর দিতে পারেননি বিএমডিএর এই প্রকল্প পরিচালক। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close