প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বিশ্ব নদী দিবস আজ

অস্তিত্ব সংকটে শীতলক্ষ্যা

বিশ্ব নদী দিবস আজ। প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশেও নানা আয়োজন থাকে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। তুরাগ নদ রক্ষায় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ওই রায় দেয় হাইকোর্ট।

এর আগে ২০১৭ সালে কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত ‘রিয়ো এট্রাটো’ নামক একটি নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে। নদীটি সোনা আর কয়লার খনির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতে সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায় ও অন্যদের জন্য ব্যাপক সমস্যা হচ্ছিল।

নিউজিল্যান্ডের একটি নদীকেও জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়, ওই নদীকে সেখানকার মানুষ খুবই পবিত্র মনে করে একে ঘিরে নানা উপাসনাও করত। ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজ্য আদালত থেকে নর্মদা নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদ-নদী দখল-দূষণে ধুঁকছে। নদ-নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে। দখল-দূষণ থেকে বাদ যায়নি একদা স্বচ্ছ শ্রোতস্বীনি শীতলক্ষ্যা নদী। আজ সেই শীতলক্ষ্যা নিয়ে গাজীপুরের কালীগঞ্জ এবং নরসিংদীর পলাশ থেকে সেখানকার প্রতিনিধিরা রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন, কালীগঞ্জ উপজেলার মূলগাঁও এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতীরবর্তী দেশের খ্যাতনামা একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচামাল বহনকারী অসংখ্য মালবাহী জাহাজ নদীতে অননুমোদিত যত্রতত্র নোঙর করে রাখা হয়েছে। কারো কারো ইটিপি থাকলেও বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখে। তবে প্রশাসনের অভিযানের খবরে সচল হয় তাদের সেই ইটিপি।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের এক জরিপে জানা গেছে, সারা দেশে ৬৫ হাজার ১২৭ জন নদী দখলদার রয়েছে। তবে এরমধ্যে ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে।

শীতলক্ষ্যা নদীপাড়ের বাসিন্দা কালীগঞ্জ পৌর এলাকার বালীগাঁও গ্রামের মৃত সুবানি মন্ডলের ছেলে বিষ্ণু মন্ডল (৪৫) জানান, শীতলক্ষ্যায় মাছ ধরে আমার বাপ-দাদারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। বংশপরম্পরায় সেই পেশাকে এখন আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।

কারণ নদীপাড়ের শিল্প-কারখানার বর্জ্যে দূষিত শীতলক্ষ্যায় আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। কালীগঞ্জ খেয়াঘাটের মাঝি, নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলামপাড়া গ্রামের মো. বাচ্চু মিয়ার ছেলে মো. বকুল মিয়া (৪৬) বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে এই শীতলক্ষ্যার বুক চরে বেড়াচ্ছি। একসময় নদীটি অনেক বড় ছিল। দুই পাড়ের শিল্প-কারখানার অবৈধ দখলে নদীটি ছোট হয়ে গেছে। এই ধারা বজায় থাকলে এক দিন হয়তো শীতলক্ষ্যার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসক জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি একই সঙ্গে তিনি জেলা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক। জেলা প্রশাসক পরিবেশ অধিদপ্তর, মৎস্য অফিস, কৃষি অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআরডিবি, পরিবেশবাদী, জনপ্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়ার প্রতিনিধির সমন্বয়ে নদী রক্ষার কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০, পানি আইন ২০১৩, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ কঠোর প্রয়োগে সুফল আসতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. আসসাদিক জামান বলেন, সরকার সারা দেশে নদীর যে স্বাভাবিত প্রবাহ, তা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে নদী খননের কার্যক্রমও রয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএ নদী নিয়ে কাজ করছে।

তিনি আরো বলেন, ইটিপি ছাড়া যদি কেউ ময়লা পানি বর্জ্য নিঃসরণ করে, তাহলে তাদের আমরা অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসব এবং প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত করব। আর নদীর সীমানা হচ্ছে সিএস নকশায়। সুতরাং সিএস নকশায় স্থাপনা থাকলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পলাশ (নরসিংদী) প্রতিনিধি আল-আমিন মিয়া জানান, নরসিংদীর পলাশ অংশে শীতলক্ষ্যা নদী ভরাট করে ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর প্রবাহ। বৃষ্টির পানি নামতে পারছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যে মাত্রায় শীতলক্ষ্যা দূষিত হচ্ছে, তাতে নদীটির পানি ঘর-গৃহস্থালি ও কৃষিকাজের ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।

স্থানীয়রা জানান, এখানকার শীতলক্ষ্যার পানি হাতে বা শরীরে লাগলে চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নদী ভরাট, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও স্থাপনা নির্মাণ করছেন।

তারা আরো জানান, উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের কৃষিজমিগুলো ছিল ফসলে ভরা। নদীতে ছিল নানা প্রজাতির মাছ। এখন শীতলক্ষ্যায় বিপন্ন জীববৈচিত্র্য, আর বেকার জেলে পরিবার।

তারা আরো জানান, কারখানা গড়ার আগে স্থানীয় কিছু মানুষকে সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। আর চাকরির কারণে স্থানীয়রাও তেমন কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নদী রক্ষায় আন্দোলন করে। আর নীতিনির্ধারকরা বরাবরই উদাসীন থাকেন।

ঘোড়াশাল পৌর এলাবার জামালপুর গুদারাঘাটের নৌকার মাঝি হাসমত আলী বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত এই ঘাটে নৌকা চলাই। নদীর পানি আগে এতটাই দূষিত যে নৌকা চালাতে ভয় হয়। ‘বাঁচাও শীতলক্ষ্যা’ আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহবুব সৈয়দ বলেন, একটা সময় আসবে যখন দেশজুড়ে নগর-জনপদের বিপুল পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে নদী থেকে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনক মাত্রায় নিচে নেমে গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close