কামাল হোসেন, রাজবাড়ী

  ১৮ আগস্ট, ২০২২

নির্ধারিত সময়ের বাইরেও লোডশেডিং

রাজবাড়ীতে ক্ষুদ্রশিল্প বিপর্যস্ত

* ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ থেকে ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না * তীব্র গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত * আমন ধানের ফলন বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা

রাজবাড়ী জেলায় লোডশেডিংয়ের নির্ধারিত সময়সূচির বিন্দুমাত্র ঠিক রাখতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে এক বা দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেওয়া হলেও দফায় দফায় হচ্ছে লোডশেডিং। যখন-তখন চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরো ভয়াবহ।

পল্লীবিদ্যুতের গ্রাহকরা বলছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ থেকে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। রাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন তীব্র গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে আমনের সেচব্যবস্থা ব্যাহত হয়ে কৃষি খাতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে রাতেও ঘরে থাকতে পাড়ছেন না খেটে খাওয়া মানুষ। বেশি বিপাকে পড়েছেন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না পাওয়ায় শিডিউল ঠিক রাখতে পারছেন না তারা। এদিকে আমন ধানের মৌসুম শুরু হওয়ায় এমনিতেই অনাবৃষ্টির কারণে সম্পূর্ণ সেচের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে রাজবাড়ীর কৃষকদের। লোডশেডিংয়ের কারণে আমন ধানের ফলন বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

রাজবাড়ীর সর্ব দক্ষিণের উপজেলা বালিয়াকান্দি। বিদ্যুৎ বিভাগ ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লোডশেডিং থাকার কথা। কিন্তু এই উপজেলায় কোনো কোনো দিন ৮ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং থাকছে। এতে এখানকার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়া ডাঙ্গাহাতি মোহন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যন্ত এই গ্রামে ২০১৫ সালে জলিল মিয়া জুট মিলস লিমিটেড নামক একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সহজে শ্রমিক পাওয়া, ভালো বিদ্যুৎ সরবরাহসহ নানা কারণে কয়েক বছরে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু বিদ্যুতের এই ভয়াবহ সংকটে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের ঝুঁকিতে পড়েছে।

জলিল মিয়া জুট মিলস লিমিটেডের অফিস সূত্র জানায়, তাদের জুট মিলস ২০ ফ্রেমের। এর মধ্যে ৭-৮টি ফ্রেম চালু থাকলে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় গড়ে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় ২৩০০ থেকে ২৪০০ ইউনিটের মতো। পল্লীবিদ্যুতের নির্ধারিত বাণিজ্যিক মূল্য হিসেবে বিদ্যুতের খরচ প্রতিদিন ৩২ হাজার ২০০ থেকে ৩৫ হাজার ১০০ টাকা।

আর ৬৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর চালাতে প্রতি ঘণ্টায় ডিজেল লাগে ৫২-৫৫ লিটার। ২৪ ঘণ্টায় ডিজেল লাগে ১২৪৮ থেকে ১৩২০ লিটার পর্যন্ত। যার বর্তমান বাজারমূল্য (১১৫ টাকা লিটার) ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০ থেকে ১ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ টাকা।

জলিল মিয়া জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফরিদ হোসেন বাবু জানান, জ¦ালানি সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুতের উৎপাদন বন্ধ রেখে লোডশেডিং কোনো সমাধান হতে পারে না। কারণ, লোডশেডিংকালীন জেনারেটরে জ¦ালানি তেল খরচ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এজন্য জ¦ালানি তেল কিনতেই হচ্ছে। এতে আরো জ¦ালানি অপচয় হচ্ছে। লোডশেডিংকালে জেনারেটর দিয়ে এক লিটার ডিজেলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ওই একই জ¦ালানিতে তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদান করতে পারে।

রাজবাড়ী পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি থেকে সরবরাহ করা বালিয়াকান্দিতে চলতি মাসের লোডশেডিংয়ের চিত্রে দেখা যায়, ১ আগস্ট ৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট, ২ আগস্ট ৩ ঘণ্টা ৫৭, ৩ আগস্ট ৫ ঘণ্টা ২১, ৪ আগস্ট ৮ ঘণ্টা ৫৬, ৫ আগস্ট ২ ঘণ্টা ৪৬, ৬ আগস্ট ২ ঘণ্টা ৪৬, ৭ আগস্ট ৩ ঘণ্টা ১৪, ৮ আগস্ট ২ ঘণ্টা ৪৩, ৯ আগস্ট ৩ ঘণ্টা ৯, ১০ আগস্ট ২ ঘণ্টা ২ এবং ১১ আগস্ট ১ ঘণ্টা ৯ মিনিট লোডশেডিং ছিল।

অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সরবরাহ করা বিদ্যুতে শনিবার (১৩ আগস্ট) বালিয়াকান্দিতে রাত ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত লোডশেডিং চলে। এরপর সকাল সাড়ে ৮টায় বিদ্যুৎ চলে যায়, টানা সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর বিকাল ৩টায় বিদ্যুৎ আসে। আবার বিকাল ৫টা ৫১ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়ে ৬টা ৮ মিনিটে বিদ্যুৎ আসে। ফের রাত ৯টা ৬ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়ে ৯টা ১৮ মিনিটে বিদ্যুৎ আসে। রবিবার (১৪ আগস্ট) সকাল ১০টা ৪১ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়ে শেষ হয় দুপুর ১টায়। ফের ৩টা ৪১ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়।

এদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের শিকার হয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন বালিয়াকান্দির ক্ষুদ্র উৎপাদানশীল শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ওয়েস্টার্ন জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সরবরাহ করা বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন স্বল্পপুঁজির উদ্যোক্তারা। সরেজমিনে বালিয়াকান্দি বাজারের বন্যা ফুড প্রোডাক্টস নামক খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৫ জন কর্মচারী অলস বসে আছেন। মিক্সার মেশিন ও অন্যান্য মেশিন চালানোর জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই তাদের বিদ্যুৎ না থাকলে বসে বসে বিদ্যুতের অপেক্ষা করতে হয়।

এ সময় কথা হয় প্রতিষ্ঠানের মালিক হাসিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বিদ্যুতের এই পরিস্থিতিতে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চালানো অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলে শ্রমিকরা বসে থাকতে বাধ্য হন। এতে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু পণ্যের দাম একই আছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ইচ্ছে করলেও দাম বাড়ানো যায় না। এতে তাদের প্রতিদিনই লোকসান গুনতে হচ্ছে।

স্থানীয় সাংবাদিক সোহেল মিয়া জানান, বালিয়াকান্দিতে বিদ্যুৎ অফিস না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে উপজেলাবাসীর ভোগান্তির সীমা নেই। ছোট-বড় সব ধরনের সমস্যার জন্য এ এলাকার গ্রাহকদের রাজবাড়ী জেলা সদরে ঘুরতে হয়। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ খরচসহ সময়ের অপচয় হয়।

ওয়েস্টার্ন জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের উপসহকারী প্রকৌশলী (বালিয়াকান্দি) বাপ্পি দাস জানান, বালিয়াকান্দি ও রাজবাড়ীর কয়েকটি এলাকায় তাদের সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তাদের প্রয়োজন হয় অন্তত ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু তারা পান মাত্র ১২ মেগাওয়াটের মতো। এতে অঞ্চল ভাগ করে লোডশেডিং দিতেই হয়। অন্যদিকে সময় বিশেষ বিদ্যুতের চাহিদা বাড়া-কমার কারণে শিডিউল মেনে লোডশেডিং দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় শিডিউলে থাকলেও লোডশেডিং দিতে হয় না। আগামী ১ মাসের মধ্যে লোডশেডিংয়ের সময় অনেকাংশে কমে আসবে বলে তিনি জানান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close