প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
ঋণ পেতে আইএমএফের সঙ্গে জোর আলোচনা
* ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ * আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি, ডলার সংকট
অর্থনৈতিক সংকটের মুখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হওয়া বাংলাদেশের জন্য এবারই প্রথম নয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই সর্বোচ্চ ঋণ চাওয়া হয়েছে, যার অঙ্ক ৪৫০ কোটি ডলার। এ ঋণ নিয়ে এখন আইএমএফ এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে জোর আলোচনা চলছে। গণমাধ্যমে খবর এসেছে যে, আইএমএফ বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার জন্য। এজন্য সরকার এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অতীতেও ঋণ দেওয়ার সময় ভর্তুকি তুলে নেওয়া এবং নানা ধরনের সংস্কারের শর্ত বাংলাদেশকে মানতে হয়েছিল। খবর বিবিসির।
ঋণের ইতিহাস : বাংলাদেশের এর আগে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল ১০ বার। প্রথমবার ঋণ নিয়েছিল ১৯৭৪ সালে। আইএমএফের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঋণের জন্য সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গেছে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে। এই ১০ বছরে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে পাঁচবার অর্থ ধার করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অর্থনৈতিক অবস্থা যেহেতু ভালো ছিল না সেজন্য বিভিন্ন সময় ঋণ চাইতে হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দেশটিতে সামরিক শাসন থাকায় তেমন কোনো অর্থনৈতিক সংস্কারও হয়নি। ফলে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
বড় সংস্কার হয়েছে ১৯৯০-এর দশকে : আইএমএফ যখনই বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দিয়েছে তখনই তারা কিছু শর্ত বা পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে আবার কিছু মেনে নেয়নি। ঋণের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে আইএমএফের বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। সেসব শর্তের আলোকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর চালু করা হয়।
এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও এসেছিল। এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল। তখন আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের হয়ে বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন ড. আহসান মনসুর। তিনি নিজেও এক সময় আইএমএফে কাজ করেছেন।
আহসান মনসুর বলেন, ভ্যাট চালু করার পর প্রথম সাত থেকে আট বছর বেশ ভালো ফল পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছিল ১৯৯০ এর দশকে বলছেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ‘এর ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি পরিস্থিতির উন্নতি হয় এবং রপ্তানি বাণিজ্যেও সেটির ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।’ ‘অর্থাৎ আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি করার সক্ষমতা সম্ভব হয়েছে।’ বাণিজ্য উদারীকরণে এবং গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালুর পর বাংলাদেশে ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগও এসেছিল। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তিও ব্যাপকভাবে যাওয়া শুরু হয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার তেমন একটা ঘাটতি ছিল না। এসব কারণে ১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশের ঋণ সহায়তার প্রয়োজন ছিল না, বলেন মি. মোয়াজ্জেম।
১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। এরপর বাংলাদেশ আবার আইএমএফের কাছে থেকে ঋণ নেয় ২০০৩ সালে। সেবার বড় শর্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। তখন আইএমএফের শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। এ নিয়ে তখন তীব্র বিতর্ক হলেও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সে সময় আদমজী জুটমিল বন্ধের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ছিল।
‘আদমজী জুটমিলের জায়গায় এখন আদমজী ইপিজেড হয়েছে। সেখান থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছেন এবং সে পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে সেটি আমাদের অনুমান আদমজী জুটমিল থেকে পাওয়া যেত না,’ বলেন গোলাম মোয়াজ্জেম। সর্বশেষ ঋণ নিয়েছিল ২০১২ সালে যার পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
২০১২ সালে ট্যাক্স পলিসির ক্ষেত্রে কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। সে সময় নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদের হার নির্দিষ্ট করে তা কৃত্রিমভাবে ধরে না রেখে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ।
কেন আইএমএফের দ্বারস্থ হয়
সাধারণত যখন কোনো দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় রকমের ঘাটতি তৈরি হয় তখন তারা আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যখন কোনো দেশ ঘাটতিতে পড়ে। যখন বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষত ডলারের ঘাটতি তৈরি হয় তখন আইএমএফ ঋণ দিয়ে থাকে। একটা দেশের যখন আর কোনো উপায় থাকে না তখন তারা আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে বর্ণনা করছেন ড. আহসান মনসুর।
তিনি মনে করেন, আরো আগে থেকেই আইএমএফের সাহায্য নেওয়া উচিত। সর্বোত্তম হচ্ছে তাদের কাছে না যাওয়া। আর সংস্কার যদি করতেই হয়, তা নিজেই করে ফেলা। আইএমএফের শর্ত সব সময় খারাপ- এমন কথা মানতে রাজী নন অনেক অর্থনীতিবিদ। আইএমএফ চায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভালো হোক। যাতে ঋণ গ্রহণকারী দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকে।
আহসান মনসুর বলেন, ভর্তুকির বিষয়টি যদি এমন একটি পর্যায়ে চলে যায় যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তখন আইএমএফ কেন টাকা দেবে? তারা তো ঋণের অর্থ ফেরত চায়।
"