কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ০৭ আগস্ট, ২০২২

৪০০ একর পাহাড় ন্যাড়া অপরাধীদের আস্তানা

* চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুরে মাদক হত্যাকাণ্ড * পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি * ১০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় বসতি

চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর। বছরের পর বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রায় ৪০০ একর পাহাড় ন্যাড়া করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক সাম্রাজ্য। সরকারি পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি থেকে শুরু করে মাদক, খুনসহ এমন কোনো অপরাধ নেই এখানে হচ্ছে না। শহর থেকে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো নয়। অত্যন্ত দুর্গম এলাকা কিন্তু এলাকার ভেতরে না গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না এখানে আসলে কি হচ্ছে। চারদিকে কড়া পাহারা। ভেতরে কেউ গেলে তাকে পড়তে হয় জবাবদিহিতায়। হুমকি-ধমকিও চলে। ১০ কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে এ অপরাধ জগতের বিস্তার।

পুলিশ জানায়, অনেক বছর ধরে এ সাম্রাজ্যের নায়ক আক্কাস, ইয়াসিন ও মশিউর। ৯০-এর দশক থেকে চট্টগ্রামের বিশাল এ পাহাড়ি এলাকা ঘিরে অপরাধের বিস্তার ঘটতে থাকে। সরকারি জমি দখল করে প্লট বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যা এখানে সংঘটিত হচ্ছে না। দুর্গম এলাকা বলে অনেকবার সরকারি উদ্যোগে দখলদার উচ্ছেদের চেষ্টা চলেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাহাড়ের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীরা বরাবরই থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১০ সালে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আক্কাস নিহত হলে মশিউর ও ইয়াসিনের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়।সবকিছুই যখন প্রশাসনের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন টনক নড়ে সবার। শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হতে থাকা বিশাল এলাকা। নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার কঠোরভাবে মাঠে নামে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মশিউর ও ২০২২ সালের জুলাইয়ে ইয়াসিন গ্রেপ্তার হলে প্রশাসন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, বিশাল এ এলাকায় সবুজ পাহাড় ছিল। মানুষের বসতি ছিল না। ২০০০ সালের পর বিভিন্ন স্থান থেকে অপরাধীরা এখানে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করে। প্রশাসনের অগোচরে মুষ্টিমেয় লোক পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলে। ভেতরে ভেতরে প্রায় ৪০০ একর পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে এখানে ২৪ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক লোকের বসবাস। তিনি বলেন, জঙ্গল সলিমপুর দেশের অভ্যন্তরে আরেক সাম্রাজ্য। আলীনগরে প্রবেশ করতে পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। কোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনসেট নেওয়া যায় না। প্রবেশমুখে সোর্স থাকে। অপরিচিত লোক ঢুকলে ভেতরের লোকজনদের জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে ভেতরে থাকা লোকজন মহিলাদের অগ্রভাগে দিয়ে ভেতরে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ২০১৭ সালে এবং ২০১৯ সালে উচ্ছেদে গেলে বাধার মুখে পড়ে প্রশাসন। এমনকি গত ১৪ মে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সলিমপুর পরিদর্শনের সময় একইভাবে নারীদের দিয়ে মানববন্ধন সৃষ্টি করা হয়।

এখানে ২০০৭ সালের পর থেকে বেশি দখল হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা চিহ্নিত আসামিদের অবস্থান রয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ৪-৫টি করে খুনের মামলাও রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সরকারি খাস জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে অপরাধের এই সাম্রাজ্য। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালেও এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। একে তো পাহাড়ি এলাকা, তার ওপর চলাচলের রাস্তা নেই। প্রশাসনিক কাঠামোতে জঙ্গল সলিমপুরের অবস্থান সীতাকুণ্ড উপজেলার আওতায় হলেও ওই এলাকায় প্রবেশ করতে হয় চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাবাজার এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বায়েজিদণ্ড সীতাকুণ্ডের রাস্তা খোলার পর থেকে এলাকাটির ওপর নজর পড়ে প্রশাসনের। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে এক কিলোমিটারের মতো এগোলে দেখা যায় ছিন্নমূলের বসতির। বিশাল এলাকায় খণ্ড খণ্ডভাবে বসতি ঘর। রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে আধাপাকা মাদ্রাসা ও টিনের ঘর। খালি প্লটে জমির ‘মালিকের’ নাম লেখা ছোট ছোট বহু সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। ছিন্নমূল সংগ্রাম পরিষদের বিস্তৃতি ব্যাপক এলাকাজুড়ে। আক্কাসের আমলে করা এ সমিতির সদস্য সংখ্যা এখন ২০ হাজারের ওপরে। এ সমিতির মধ্যে কথিত সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন সদস্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নিম্ন আয়ের লোক। অনেকে সর্বনিম্ন ২০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা দিয়ে প্লটের মালিক বনেছেন। সরকারি এসব (খাস জমি) জায়গা দখল করে চলে বিক্রি। কথিত ছিন্নমূল সমিতি পুরো এলাকাকে ১১টি সমাজে ভাগ করে দেয়। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন ছিন্নমূলের নেতারা। ওই এলাকার ভেতরে রয়েছে ১২টির মতো মসজিদ, চারটি মাদরাসা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চবিদ্যালয়, তিনটি কেজি স্কুল, তিনটি এতিমখানা, ছয়টি কবরস্থান, পাঁচটি মন্দির, দুটি কেয়াং, একটি গির্জা, একটি শ্মশান এবং কয়েকটি কাঁচাবাজার। সমিতির সদস্যপদ নিতে হয় ৫০০ টাকা দিয়ে। পরে সমিতিকে টাকা দিয়ে পাহাড়ের ভেতরে একেক খণ্ড জমির দখল নিয়ে ঘর তুলেছেন তারা।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ভেতরে এ ধরনের বিশাল এক সাম্রাজ্য ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। বরং অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের ভেতরে থাকা অনেকে টাকার বিনিময়ে এদের সহায়তা করে আসছিল। অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে সরকারের উচ্চমহলে এ এলাকা নিয়ে আলোচনা শুরু হতে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০০৬ সালে সরকারি এই জমির বন্দোবস্ত চেয়ে আবেদন করে ছিন্নমূল। কিন্তু কোনো সাড়া না মেলায় থমকে যায় সব। পরে ২০১৬ সালে ৬০০ একর জমির বন্দোবস্ত চেয়ে আবার আবেদন করলে সীতাকুণ্ডু উপজেলা প্রশাসন বন্দোবস্তের পক্ষে মত দিয়ে একটি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছিল। পরে অবশ্য ছিন্নমূলরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কাগজে-কলমে সরকারের কাছে আবেদনের নথি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে নিজের সহায়-সম্বল বিক্রি করে সরকারের জমি নেয়। পুরো পাহাড়ি এলাকায় এখন প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের বাস।

জানা গেছে, পাহাড়ে এই অবৈধ বসতিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গ্রুপ গড়ে ওঠে। এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গত ২০০৪ সালে একাধিক পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ব্যাপকভাবে দেখা দিলে তার ছোঁয়া থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। ২০১০ সালে স্থানীয় লাল বাদশা ও আলী আক্কাসের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনার পর র‌্যাব মাঠে নামে। দুর্গম পাহাড়ে র‌্যাব অভিযান চালাতে গেলে ক্রসফায়ারে মারা যায় ভূমিদস্যু আক্কাস। আক্কাস মারা যাওয়ার পর বাকিরা গা ঢাকা দেয়। আক্কাসের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে ছদ্মপতন হতে থাকে। আক্কাস মারা যাওয়ার পর ওই এলাকায় শক্তিশালী হয়ে উঠে ইয়াসিন ও মশিউর।

এদিকে গত ১৫ জুলাই বিকালে সীতাকুণ্ডের সলিমপুর এলাকায় জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকার পরিদর্শনে যান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওইদিন কার্যক্রম শেষে ফিরে আসার সময় আলীনগর এলাকায় পরিদর্শন টিমের বহরে থাকা স্থানীয় সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. আরিফকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়। এ হামলায় ইয়াছিনের নেতৃত্বে ২৫ জনের মতো সন্ত্রাসী অংশ নেয়। এ সময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় ১৬ জুলাই আহত আরিফের ভাই আবদুল আলীম বাদী হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেন। মামলায় ইয়াছিনসহ ১৫-১৬ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় পুলিশ ইয়াছিনকে গ্রেপ্তার করে।

ঘটনার পর চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর যেকোনো মূল্যে অবৈধ দখল মুক্ত করার জন্য নির্দেশনা আসে। এরই অংশ হিসেবে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলনকক্ষে জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে মহাপরিকল্পনা ও সেখানে বসবাসরত ভূমিদস্যুদের হাত থেকে সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। তিনি সলিমপুরে ভূমিদস্যু সৃষ্ট সব প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নির্দেশনার পর জঙ্গল সলিমপুর ঘিরে মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে স্পোর্টস ভিলেজ, হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, সাফারি পার্ক, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কাস্টমস ডাম্পিং হাউস, সবুজ শিল্প এলাকা, চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও বিএমএ এবং আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close