মো. মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ০৩ আগস্ট, ২০২২

লক্ষ্য অর্জনে ফের সংশয়

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে ৮০৮ কোটি টাকা। তবে সুষ্ঠু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বন্দর ও কাস্টমসে এখনই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন না হলে সামনেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কাস্টমস ও বন্দর সূত্রে জানা যায়, প্রতি অর্থবছরের শুরুতে দেশের সব কটি বন্দরে আমদানি পণ্যের ওপর সম্ভাব্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নানা অব্যবস্থাপনায় গত অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বন্দরে পণ্য আমদানি কম হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার টন। এই অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয় ২১ লাখ ১৪ হাজার টন। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ২৬ লাখ ৪৪ হাজার টন পণ্য। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টম হাউসে ৫৫৮ কোটি টাকা ৮ লাখ টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। অর্থবছরটিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৫৯৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ২৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ওই বছর ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৯৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয়েছিল ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয় ২০ লাখ ১১ হাজার ৬ টন পণ্য।

বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা জানান, যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় দুদেশের ব্যবসায়ীদের এ পথে বাণিজ্যের আগ্রহ বেশি। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো পণ্য আমদানি করতে পারেন না। বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ ট্রাক পণ্য আমদানির চাহিদা রয়েছে। বেনাপোল বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে দিনে ৩৫০ ট্রাকের বেশি পণ্য আমদানি সম্ভব হয় না। ভারী পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে বন্দরে পর্যাপ্ত ক্রেন, ফর্কলিফট না থাকায় ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো পণ্য খালাস নিতে পারেন না। ফলে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছেন।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, বেনাপোল বন্দরে তীব্র জায়গা সংকট। পণ্য ওঠানামার ক্রেন ফর্কলিফট নষ্টের কারণে সঠিক সময়ে আমদানিকারকরা পণ্য খালাস নিতে পারে না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী এ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। এতে বেনাপোল দিয়ে আমদানি কমে গেছে। তবে বেনাপোল বন্দর উন্নয়ন, ভারতে হয়রানি বন্ধ হলে এ বন্দর থেকে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ রাজস্ব আয় কাস্টমসের পক্ষে সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, বেনাপোল বন্দর দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর হওয়ার পরও নানা অব্যবস্থাপনায় বারবার বন্দরে ঘটে চলছে অগ্নিকাণ্ড। এতে লোকসানের কবলে পড়ে এ বন্দর ব্যবহার কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে দেখা গেছে, ১১ বছর ধরে সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। গেল অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ হাজার ১৫৮ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছিল মাত্র চার হাজার ৫৯৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ সময় রাজস্ব ঘাটতি হয়েছিল ৫৫৯ কোটি টাকা। বছরটিতে পণ্য আমদানি কমেছিল চার লাখ ৩০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এতে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানান।

বেনাপোল আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান, বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত। কারণ নানা অব্যবস্থাপনায় আমদানি কমেছে এ বন্দর দিয়ে। বেনাপোল কাস্টমসে আমদানি পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষণে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেই। এখানে পণ্যের টেস্ট করা হলেও সে রিপোর্ট মানেন না কর্মকর্তারা। তারা সেটা পুনরায় পরীক্ষার জন্য পাঠান খুলনা ও ঢাকায়। সেখান থেকে পরীক্ষা করাতে মাসের অধিক সময় লেগে যায়। ফলে দীর্ঘ সময় পণ্য চালান আটকা পড়ে ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বেনাপোল কাস্টম হাউসে বিএসটিআই ও বিএসআইআরের শাখা স্থাপনের দাবি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এতে অনেক ব্যবসায়ী এ বন্দর ছেড়েছেন।

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব-কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, ব্যবসায়ীরা যেখানে সুবিধা পাবেন সে পথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আগ্রহী হবেন এটাই স্বাভাবিক। চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক সুবিধা বিদ্যমান তাই ব্যবসায়ীরা দিন দিন সে পথে আমদানিতে ঝুঁকছেন। বেনাপোল বন্দর দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কাস্টমস ও বন্দরে বৈধ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীরা এ পথে আবার ফিরবেন।

বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর জানান, বেনাপোল বন্দরের উন্নয়নকাজ চলমান। এরই মধ্যে বন্দরে ৩৬৫টি সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এতে নিরাপত্তা বাড়বে। জমি অধিগ্রহণ, নতুন পণ্যাগার নির্মাণ ও বন্দর এলাকায় রাস্তাঘাটের অনেকটা উন্নয়নকাজ করা হয়েছে। উন্নয়নকাজ সমাপ্ত হলে এ বন্দরের বাণিজ্যে আরো গতি বাড়বে।

বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান জানান, এনবিআর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। গত বছরের চেয়ে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে ৮০৮ কোটি টাকা। গেল অর্থবছরে আমদানি কম হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার টন। বেনাপোল বন্দরে জায়গার সংকট, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। এসব কারণে গত বছর আমদানি কমে গেছে। এতে রাজস্ব আদায়েও প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে না বলে তিনি জানান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close