প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৬ জুন, ২০২২

মেগাসিটি বসে যাচ্ছে!

জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে কী করা উচিত, সে বিষয়ে তেমন সংশয় নেই। কিন্তু সদিচ্ছার অভাবে বিশাল বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে উপকূলবর্তী শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কোটি কোটি মানুষ আসলে ডুবন্ত শহরে বাস করছেন। কারণ জাকার্তা থেকে লাগোস পর্যন্ত বেড়ে চলা মেগাসিটির আরো বড় সমস্যা হলো, সেখানে জমি বসে যাচ্ছে। কয়েকটি নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে সমুদ্রের পানির স্তর বাড়ার তুলনায় জমি দশ গুণ দ্রুতগতিতে নেমে যাচ্ছে। জাতিসংঘের হ্যাবিটাটের নির্বাহী পরিচালক মাইমুনাহ মহম্মদ শরিফ মনে করেন, মানুষের ঘরবাড়ি, জীবিকার ওপর এর প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমি বসে যাওয়ার কারণে উপকূলবর্তী এলাকা আর বাসযোগ্য থাকবে না বলে মনে হচ্ছে। আমরা সতর্ক না হলে কয়েকটি শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ গতকাল শনিবার এ তথ্য জানা গেছে ভারতের গণমাধ্যম জিনিউজ সূত্রে।

এর কারণ, আমরা নদীর গতিপথ বদলে দিয়েছি এবং নরম মাটির উপর শহর গড়ে তুলেছি। গত শতাব্দীতে ব্যাংকক শহর এক মিটারেরও বেশি নেমে গেছে। শাংহাই দুই মিটার, ইটালির পো নদীর ব-দ্বীপ তিন মিটারের বেশি এবং টোকিওর পূর্বের অংশ চার মিটারের বেশি বসে গেছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের কিছু অংশের জমি একটা গোটা বাড়ির সমান নেমে গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায় ৩০ বছর পর শহরের উপকূলবর্তী অংশ পুরোপুরি পানির নিচে চলে যাবে। বান্দুং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভূবিজ্ঞানী হেরি আন্দ্রেয়াস বলেন, ‘আমাদের সরকার পানি সরবরাহের মাত্র ৬০ শতাংশ পাইপের মাধ্যমে করতে পারে। বাকি ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে।’

সেসঙ্গে জাকার্তা জলাভূমির উপর অবস্থিত। আশপাশে ১৩টি নদী রয়েছে। তার উপর বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহরও বটে।

তবে জাকার্তাই একমাত্র এমন শহর নয়। বেশিরভাগ নদীর ব-দ্বীপ স্বাভাবিক পরিস্থিতির তুলনায় আরো দ্রুত নেমে যাচ্ছে। সে ক্ষতির ধাক্কা আরো দূরে টের পাওয়া যাচ্ছে। শস্য নষ্ট হওয়ার কারণে চাল ও গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। হেরি আন্দ্রেয়াসের মতে, এমন ধরনের বিপর্যয় নীরবে নষ্ট দেয়।

পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে চলেছে। এক বড় আকারের গবেষণায় জানা গেছে, বিজ্ঞানীরা আসলে বন্যার ঝুঁকিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অনেক কম মনে করেছিলেন। ক্লাইমেট সেনট্রাল সংগঠনের প্রধান বেন স্ট্রাউস বলেন, ‘মনে হতে পারে, বিজ্ঞানী মহল ও সরকারগুলো উপকূলবর্তী এলাকার উচ্চতা সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু দেখা গেছে, পৃথিবীর উপকূলের বেশিরভাগ অংশের জন্য স্যাটেলাইটভিত্তিক তথ্য ও স্যাটেলাইট সেন্সরের ওপর নির্ভর করা হয়। অথচ সেই সেন্সর বাড়ির ছাদ বা গাছের সঙ্গে জমির পার্থক্য বুঝতে পারে না।’

ক্লাইমেট সেন্ট্রালের বিজ্ঞানীদের সূত্র অনুযায়ী, উপকূল অঞ্চলে বন্যা হলে মূল অনুমানের তুলনায় তিন গুণ বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

সেই গবেষণায় অবশ্য প্রাচীর, উঁচু জমি বা আলের মতো উপকূল সুরক্ষার ব্যবস্থাগুলো বিবেচনা করা হয়নি। ফলে সব শহর একই ঝুঁকির মুখে নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ডুবে যাওয়ার জন্য সেগুলোর জায়গাও অনেক কম। বেন স্ট্রাউস বলেন, ‘আপনি যে জায়গায় রয়েছেন, সেখানকার সুরক্ষার জন্য উঁচু জমি থাকলেও আপনার জমি আরো অনেক গভীরে নেমে যেতে পারে।’

চীনের যেসব এলাকা ২০৫০ সালের মধ্যে প্লাবিত হতে পারে, সে অঞ্চলে ৯ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বাস। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট সেন্ট্রাল। চীনের সবচেয়ে জনবহুল শহর সাংহাই পর্যাপ্ত উপকূল সুরক্ষার অভাবে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে।

বিশেষ করে পানির ধাক্কায় যে সব মানুষের অন্য কোথাও চলে যাবার সামর্থ্য নেই, তাদের জন্য এটা একটা বিপর্যয় হতে পারে। মাইমুনাহ মহম্মদ শরিফ বলেন, ‘জাকার্তা ও ব্যাংককের মতো শহর যাতে টোকিও ও শাংহাইয়ের মতো শহরের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারে, সেটা খুব জরুরি।’

গত শতাব্দীতে যে সব শহর কয়েক মিটার বসে গেছে, সেগুলো মোটামুটি এখন স্থিতিশীল রয়েছে। টোকিও ও শাংহাই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাত্রা সীমিত করে দিয়েছে এবং পানির উৎস যাতে শুকিয়ে না যায়, সেই ব্যবস্থা করেছে।

কিন্তু জাকার্তার মতো শহরের বাসিন্দারা সহজে পানীয় জলের অন্য উৎসের নাগাল পান না। সরকারকে সবার আগে অনেক বছর ধরে নদী সংস্কার করতে হবে। তবেই পাইপের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

তার বদলে জাকার্তা শুধু বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করে বিপর্যয় এড়ানোর আশা করছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে উচ্চমূল্যে শুধু সমস্যার বিলম্ব ঘটানো হচ্ছে মাত্র। হেরি আন্দ্রেয়াস মনে করিয়ে দিলেন, যে পানি ব্যবস্থাপনার ব্যয় হবে এক হাজার কোটি ডলার। অন্যদিকে সমুদ্রের প্রাচীরের ব্যয় চার হাজার কোটি ডলার। বিজ্ঞানীদের মতে, দ্রুত কার্বন নির্গমন কমাতে পারলেই চলতি শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মাত্রা আধ মিটারের নিচে সীমিত রাখা সম্ভব। সেই সীমিত উচ্চতার পানিও অনেক শহরে বিপর্যয় বয়ে আনবে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন ওলটপালট করে দেবে। কিন্তু অন্তত শহরগুলো চলতি শতাব্দীতেও অক্ষত থাকতে পারবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close