আহমেদ জামিল, সিলেট

  ২৫ জুন, ২০২২

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহে হিমশিম

গত মাসের শুরুর দিকে টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে তলিয়ে যায় সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বাটইশাইল গ্রাম। হাওর পাড়ের এ গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও ওই গ্রামে হেঁটে যেতে হয়। প্রথম দফা বন্যায় নিমজ্জিত হয় সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বাটইশাইল গ্রাম। পরে সিলেটের অন্যান্য স্থানের পানি নেমে গেলেও পানি নামেনি হাওর পাড়ের ওই গ্রাম থেকে। দ্বিতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয় সিলেট। জেলার সবকটি উপজেলা তলিয়ে যায় পানিতে। প্রথম দফা বন্যার ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই দ্বিতীয় দফার বন্যায় ছোবলে ভয়াবহ অবস্থা দেখা দেয় বাটইশাইলে। পুরো গ্রাম তলিয়ে যায় পানিতে। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকে চলে যান আশ্রয়কেন্দ্রে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কেউ খোঁজ নিচ্ছে না ওই গ্রামের মানুষের। সিলেটজুড়ে অসংখ্য সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ দেওয়া হলে একটি ত্রাণের প্যাকেটও পৌঁছায়নি ওই গ্রামে। বন্যায় সব হারিয়ে এখন বেঁচে থাকার আর্তনাদ বাটইশাইলের প্রতিটি ঘরে ঘরে।

কেবল বাটইশাইল নয়। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার অনেক প্রত্যন্ত্র এলাকায় এখনো ত্রাণ যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে হাতেগোনা কিছু পরিবারকে সহযোগিতা করা হলেও শত শত পরিবার সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় খোঁজখবর নিচ্ছেন না এসব এলাকার খোদ জনপ্রতিনিধিরাও। এতে করে ত্রাণের সমবণ্টন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

কিছু এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা দরিদ্র মানুষের তালিকাও চূড়ান্ত করতে পারেননি। কোথাও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ত্রাণ পৌঁছালেও সেটা বিতরণে তারা গড়িমসি করছেন। ফলে অসহায় মানুষের কষ্টের সীমা নেই।

এদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ত্রাণ পাচ্ছে সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বন্যার্তরা। সরকার ও প্রশাসনের চোখও এখন এই তিন উপজেলার মানুষের দিকে। সেনা, বিজিবি ও পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতাও কেবল তিন উপজেলা ঘিরে। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটে এসে কোম্পানীঞ্জ ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ফলে আড়ালেই পড়ে রয়েছে জেলার জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জৈন্তাপুর, ওসমানীনগর ও ফেঞ্চুগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা। এ নিয়ে বন্যার্তদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের ৯টি ইউনিয়ন পানির নিচে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি। সুরমার পানি কিছুটা কমলেও কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধির কারণে জকিগঞ্জের পার্শ্ববর্তী কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও ওসমানীনগরের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। এর প্রভাব পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায়।

বন্যায় আক্রান্তরা জানান, এসব উপজেলায় বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণ পাচ্ছেন না কেউ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় দেশের অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে না। ফলে সরকারি ত্রাণে নির্ভরশীল মানুষজন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

এদিকে বন্যা দুর্গত বেশি কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যাপক হারে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও সুষ্ঠু বণ্টনের অভাবে মানুষের হাহাকার কমছে না। বেশি সহযোগিতা পাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষজন। ফলে ঘরবাড়িতে আটকে পড়া ও ঘরবাড়ি হারিয়ে ছিন্নমূল হওয়া মানুষগুলো ত্রাণ পাচ্ছে না। লোকলজ্জার কারণে অনেকে বলতেও পারছেন না। এতে করে সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করছে এই শ্রেণির বন্যা দুর্গতরা।

জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার বন্যা দুর্গতরা জানান, গণমাধ্যমে ঢালাওভাবে সংবাদ প্রচারের অভাবে এসব এলাকায় বেসরকারিভাবে এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। ত্রাণ না পেয়ে মানুষ হাহাকার করছেন। সরকারের পক্ষে থেকে যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে রয়েছেন বানভাসিরা।

সিলেটের জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় সিলেটের ৯৯টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩২০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ২২ হাজার ১৫০টি বাড়ি ও ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বন্যায় সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলায় ১৩৯৭ টন চাল ও ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত জানান, প্রতিটি এলাকায় সুষম হারে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কোনো এলাকার মানুষ যাতে বাদ না পড়েন সে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা রয়েছে।

একদিকে উন্নতি, অন্যদিকে অবনতি : বন্যা পরিস্থিতি একদিকে উন্নতি ঘটলেও অন্যদিকে অবনতি ঘটছে। সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পানি কমলেও তবে কুশিয়ারা সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বাড়ছে পানি। চার দিন ধরে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে সুরমা নদীর পানি কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, কুশিয়ারা অববাহিকতায় পানি বাড়ছে। শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত এ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারার পানি বাড়ায় জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ, দক্ষিণ সুরমা, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কুলাউড়া, রাজনগর, জুড়ি, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সিরাজগঞ্জে যমুনা পানি কমলেও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে যমুনা পানি কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার পানি কমলেও তা এখনো বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দিকে কাজিপুর পয়েন্টে পানি ২৭ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় শতাধিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত হলেও ৪৩টি বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জেলার কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালি ও শাহজাদপুর উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের ৯ হাজার ১০৩টি পরিবারের ৪৪ হাজার ৬২ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জানান। জেলায় ৫৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য ৭৭১ টন চাল ১৩ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকা মজুদ আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close