ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি

  ২৪ জুন, ২০২২

চার জয়িতার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

সমাজের ও পরিবারের নানা অসংগতি এবং আর্থিক অনটনের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবনযুদ্ধে হার মানেননি চার নারী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ওই চার জয়িতার ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম স্থানীয় নারীদের কাছে অনুপ্রেরণার স্মারক হয়ে আছে। উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে সহযোগিতায় ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শোনালেন ওই চার নারী। ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর তাদের সফলতার কথা বিবেচনা করে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র দিয়ে পুরস্কৃত করে উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।

জীবন জয়ের গল্প শোনালেন উপজেলা হাঁসপুকুর গ্রামের মো. রফিকুল ইসলামের মেয়ে মোসা. সারমিন আকতার। তিনি বলেন, তাদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ছিলেন দরিদ্র বাবা। অভাবের সংসারে তিন সন্তানকে লেখাপড়া করান। কুলিয়ে উঠতে না পেরে কৈশরেই সারমিনকে বাল্যবিয়ে দিয়ে দায় সারেন। শ্বশুরবাড়িতে যৌতুক দাবিতে শিশু সারমিনের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় শ্বশুরবাড়ির লোকরা। তার নেশাগ্রস্ত স্বামীও বাদ যায় না। সারমিন আরো জানায়, নির্যাতন সইতে না পেরে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আবার বাবার দরিদ্র পরিবারে চলে আসেন। পরে উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ নেন, পাশাপাশি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেন, যথারীতি পাসও করেন। এখন শুধু তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা।

অপরজন গোপিনাথপুর গ্রামের মো. নাসির উদ্দিনের মেয়ে মাহবুবা। তিনিও অসচ্ছল পরিবারের সন্তান, লেখাপড়া করেছেন ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত। ওই বয়সেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। অভাবের সংসারে বড় হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। এরই মধ্যে কোলজুড়ে আসে দুই সন্তান। কিন্তু সামনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই থামাননি মাহবুবা। প্রতিবেশীর কাছ থেকে শুনে উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন। সেলাই মেশিনের কাজ শেখেন। দুই সন্তানকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে সক্ষম হন। তারা এখন সরকারি চাকরি করেন। মাহবুবা জানান, তিনি এখন খুব সুখী মানুষ।

অন্যদিকে, দুর্গাপুর গ্রামের মৃত তোহর আলীর স্ত্রী মোসা. নিলুফা। তিনি বলেন, ‘আমি খুব মেধাবী ছিলাম। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে ১ম স্থান হতাম। কৈশরেই আমার মতামত ছাড়াই স্নাতক শ্রেণি পাস এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর বয়স ২৫/৩০ বছর। বিয়ের পর শুরু হয় যৌতুক দাবিতে নির্যাতন। যৌতুকের দাবি মেটাতে সহায় সম্বল বিক্রি করে দেন বাবা-মা। তারপরও স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে বসেন। বাবার বাড়ি চলে আসি। দুই বছর পর তার স্বামী ফেরত নিয়ে যান। এরই মধ্যে ২ সন্তানের মা হই। স্বামী চট্টগ্রামের একটি চামড়ার কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেখানে তার মৃত্যু হয়। শুরু হয় আরো কষ্টের দিন। পরে এলাকাবাসীর ভালোবাসায় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হই। বাল্যবিয়ে রোধসহ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিচ্ছি। এখন বেশ ভালোই আছি।

সুরানপুর গ্রামের দিনমজুর মো. জিয়াউদ্দিনের মেয়ে জাকেরা। তারা চার ভাই-বোন। শৈশবেই বাবা আরেকটা বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। অকূল দরিয়ার মধ্যেই তাদের মা লালন পালন করেন। কৌশরেই বিয়ে হয় জাকরার। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর স্বামী তার মায়ের কাছে রেখে যায়। মায়ের বাড়িতেই বড় ছেলের জন্ম হয়। সমাজের লোকরা নানা বাঁকা মন্তব্য করতে থাকে। এমন সময় হাঁস-মুরগি, সবজি চাষ করে সংসার চালাতে লাগলাম। ছেলে বড় হতে থাকে। সে এখন এসএসসি পাস করেছে। আমার আয় দিয়ে চলে তার পড়ালেখার খরচ। বর্তমানে বেশ ভালো আছি।

এই চার জয়িতার জীবন সংগ্রাম সবাইকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। এমনটাই দাবি করলেন ভোলাহাট উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মোসা. রহিমা রওনক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close