নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ মে, ২০২২

অতি মুনাফালোভীর থাবায় বিক্ষত ক্রেতা

বাজারে অতি মুনাফালোভীদের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা শতকরা ৪০ শতাংশেরও বেশি লাভ করেন। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়েও শতভাগ বেশি মুনাফা করা হয়।

দেশে মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি বাড়ে রোজার মাসে। সরবরাহ ঠিক থাকার পরেও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা লুটে। আর এর জন্য তারা কখনো সরবরাহ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে আবার কখনো পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।

তবে মুনাফালোভীরা শুধু রমজান মাস নয়, সবসময়ই অজুহাত খোঁজেন। যেমন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের খবর এলেই বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে যায়। অথচ দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের মজুত আছে। দেশে গমের মজুতে এখনো ঘাটতি না পড়লেও বাজারে দাম বাড়ছে। চালেরও একই অবস্থা।

গত মার্চে সয়াবিন তেলের দাম প্রথম দফায় বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা লিটার করা হয়েছিল। কিন্তু বাজারের হিসেব করলে দেখা যায়, পরিস্থিতি এমন হওয়ার কথা ছিল না। কেননা মার্চ মাসে দেশের বাজারে যে তেল ছিল তা ডিসেম্বরের আগে আমদানি করা। গত ডিসেম্বরে বিশ্ব বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৪১১ ডলার।

ট্যারিফ কমিশন থেকে জানা যায়, প্রতি টন আমদানিতে তখন জাহাজ ভাড়া পড়েছিল ৭০ ডলার। প্রতি টন সয়াবিন তেল চট্টগ্রাম বন্দরে আনতে খরচ পড়ে এক হাজার ৪৮১ ডলার। টাকার অঙ্কে সেটি পড়ে এক লাখ ২৭ হাজার ৩৬৬ টাকা (ওই সময়ে ১ ডলার = ৮৬ টাকা হিসেবে)। সে হিসেবে বন্দর পর্যন্ত প্রতি লিটারের দাম পড়েছে ১২৭ টাকা ৩৬ পয়সা।

বন্দরে পৌঁছানোর পর ভোক্তার হাত পর্যন্ত যেতে প্রতি লিটারে যোগ হয় আরো ২৫ থেকে ২৭ টাকা। এর মধ্যে আছে মিলে রিফাইনিং খরচ, সরকারি ভ্যাট, এআইটি, ইনস্যুরেন্স ব্যয় এবং ব্যবসায়ীদের লাভ। এই হিসেবে ভোক্তা পর্যায়ে তখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের মূল্য হওয়ার কথা ছিল ১৫২ থেকে ১৫৩ টাকা। কিন্তু বাজারে তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা।

শুধু খাদ্যপণ্যই নয়। মুনাফা করার অতি লোভ সব খাতেই চোখে পড়ে। গত ঈদে দেখা গেছে আগের দামের ট্যাগের ওপরেই দাম বাড়িয়ে নতুন ট্যাগ লাগিয়ে পোশাক বিক্রি করা হচ্ছে। এই অভিযোগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করে ভোক্তা অধিদপ্তর।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রতিটি পণ্যেই স্বাভাবিক মুনাফার চেয়ে গড়ে ৪০ শতাংশ বেশি মুনাফা করেন ব্যবসায়ীরা। আর কোনো অজুহাত পেলে তো কথাই নেই।

উদাহরণ দিয়ে নাজের হোসেন বলেন, ঈদের সময় এক হাজার টাকার কাপড় দোকানদাররা বিক্রি করেছেন ১০ হাজার টাকায়। কৃষিপণ্যে সারা বছরই অতিমুনাফাচক্র কাজ করে। কৃষক দাম পায় না। কিন্তু ওই চক্রটি দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটে নেয়।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির এই নেতা আরো বলেন, সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে দাম বেড়েছে এখানকার ব্যবসায়ীরা তার অনুপাতে বেশি দাম নিচ্ছেন। পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়ানো হলো। কিন্তু দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই।

নাজের জানান, কাপড় ও পোশাকের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশের বেশি অস্বাভাবিক মুনাফা করা হয়। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশের বেশি। গড়ে সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ বেশি অতিরিক্ত মুনাফা করা হয়।

মুনাফালোভীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, তরল দুধের দাম বাড়ল কেন? এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের কি কোনো সম্পর্ক আছে? ৬৫ টাকা লিটারের তরল দুধ এখন ৯০ টাকা। শুধু অতিমুনাফার লোভে এটা হয়েছে।

তার কথা, হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাঁচ টাকার পরোটা ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার পরোটার আকারও ছোট করা হয়েছে। কিন্তু পরোটা বানানোর পণ্যের দাম কি দুইগুণ বেড়েছে? এটা হলো একটা মানসিকতা। আমাদের সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীই সবসময় অতি মুনাফার জন্য মুখিয়ে থাকে।

বাজার দেখবে কে : বাজার অস্বাভাবিক হলে তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের। সম্প্রতি তারা কয়েকটি ভোজ্য তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।

কমিশনের সদস্য ড. এ এফ এম মনজুর কাদির বলেন, কেউ বাজার প্রভাবিত করছে কি-না অথবা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে কি-না সেটা আমরা দেখি। কিন্তু সাধারণভাবে বাজারমূল্য দেখা আমাদের কাজ নয়।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদানি করা কিছু পণ্যের দাম সরকার বেঁধে দেয়। সেটা আমরা দেখতে পারি। তবে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে তথ্য নিয়ে অন্যান্য পণ্যও আমারা দেখতে পারি। তবে সেটা আমরা এখনো শুরু করিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close