গাজী শাহনেওয়াজ
ফেরি-স্পিডবোট চলবে পদ্মা সেতু চালুর পরও
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর পর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এবং মাদারীপুরের মাঝিরকান্দি রুটে ফেরি, লঞ্চ কিংবা দ্রুতগতির যান স্পিডবোট আগের মতোই চলবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এমনই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রের।
সরেজমিনে গিয়ে মুন্সীগঞ্জ ও মাদারীপুর পদ্মার দুপাড়ে ঘুরে নানা মত পাওয়া গেছে। সেখানে পদ্মা সেতু চালু হলে মাওয়া-মাঝিরকান্দি রুট বন্ধ হবে কি না- এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। বন্ধ হলে এসব রুটে চলাচল করা যানগুলোর ঠাঁই কোথায় হবে এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই মানুষের। এত মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান হবে কী হবে না, তাণ্ডও আলোচনার বাইরে নয়। তবে এ যানগুলো যাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, সেই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ছিল এত দিন নীরব, যদিও বসে ছিলেন না তারা। পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন এ রুটটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভেতরে ভেতরে উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা ছিল তাদের।
এরই মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সরকার। চলছে সার-সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি মিললেই সব গুঞ্জন থেমে যাবে। এক সপ্তাহের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাবে কবে চালু হচ্ছে পদ্মা সেতু। তবে জুনেই চালু হবে এটা অনেকটা নিশ্চিত।
সেতুর ওপর দিয়ে নির্ধারিত ওজনের যান চলাচল করবে। সমানতালে চলবে নদীপথ দিয়ে বিদ্যমান ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট। কোন ধরনের যানবাহন সেতুর ওপর দিয়ে চলতে পারবে, সেটি পদ্মা সেতুর টেকনিক্যাল কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর বোঝা যাবে। এদিকে, ফেরির বিদ্যমান ভাড়া বাড়ানোর চিন্তা করছে মন্ত্রণালয়। আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি সম্মুখে আনা হবে। তবে পদ্মা সেতুর টোলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফেরি ভাড়া সমন্বয় করা হবে।
এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আগে নৌপথ নিয়ে মানুষ না ভাবলেও এখন ভাবছে। দিনে দিনে বরাদ্দ বাড়ছে। নির্বিঘেœ চলাচলের জন্য সুনাম রয়েছে নৌপথের। পদ্মা সেতু গর্বের ও অহংকারের সেতু হলেও বরিশালের মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তারা নৌপথেই চলতে স্বাচ্ছদ্যবোধ করবেন। তাদের ভাষায় বললে বলতে হয়, এত আরামদায়ক জার্নি আর কোনো পথে নেই। তাই পদ্মা সেতু হলেও চলবে মাওয়া টু মাঝিরকান্দি রুটে ফেরি ও স্পিডবোট। তবে লঞ্চ চলাচলের বিষয়টি সব সময় বিবেচনায় থাকবে।
বিআইডব্লিউটিসির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পদ্মা সেতু থেকে কাঁঠালবাড়ী এলাকার ঘাঁট সরিয়ে এনেছি। এখন মাওয়া থেকে মাঝিরকান্দিতে এসে থামছে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট। পদ্মা সেতু চালু হলে সবগুলো এখানে থাকবে না। কারণ বর্তমানে সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। এখন ৯টি চলছে। কয়েকটি ফেরি নগরবাড়ি ঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে। মাওয়া-মাঝিরকান্দিতে ভারী যানগুলো পার হবে। পদ্মা সেতুর টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। সেতু চালুর এক-দুই মাসের মধ্যে জানা যাবে কোন যানগুলো চলতে পারবে। আর সেতুর সঙ্গে সমন্বয় করে ফেরির ভাড়া বাড়ানো হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে পদ্মা সেতুতে উঠলেই উচ্চহারে টোল দিতে হবে। আবার মাওয়া পয়েন্টের কাছাকাছি এলাকার মানুষের ছোট যানবাহন নিয়ে সেতুতে উঠতে চাইলে উল্টোপথে ঢাকার দিকে গিয়ে উড়ালসেতু ঘুরে পদ্মা নদী পার হতে হবে। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হবে। তাই নানা দিক বিবেচনা করে নৌ-মন্ত্রণালয় ফেরি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে, দেশের ছয়টি রুটের ফেরিতে সব ধরনের গাড়ি পারাপারের ভাড়া ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিসি নৌযানেও যাত্রীপ্রতি ভাড়া ৩৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে এ-সংক্রান্ত কমিটি ভাড়া পর্যালোচনা করছে। জানা যায়, বর্তমানে ছয়টি রুটে ফেরিতে গাড়ি পারাপার করছে বিআইডব্লিউটিসি। রুটগুলো হচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা-কাজিরহাট, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার/মাঝিরকান্দি, চাঁদপুর-শরীয়তপুর, ভোলা-লক্ষ্মীপুর এবং লাহারহাট-ভেদুরিয়া। এ ছাড়া ঢাকা-বরিশাল-মোড়েলগঞ্জ, চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ, হাতিয়া, দৌলতখান ও বরিশাল এবং ঢাকা-কালীগঞ্জ রুটে চলে সংস্থাটির বেশ কিছু যাত্রীবাহী নৌযান।
বর্তমানে সংস্থাটির বহরে ১০২টি ফেরি ও যাত্রীবাহী নৌযান রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির প্রস্তাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে এক থেকে তিন টন পণ্যবাহী ছোট ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ৭৪০ থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা, ৩-৫ টনের ট্রাক ৮৮০ থেকে বেড়ে ১১০০; ৫-৮ টন পণ্যবাহী ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ১০৬০ থেকে বাড়িয়ে ১৩০০ এবং ৮-১১ টনের বড় ট্রাক ও লরির ভাড়া ১৪৬০ থেকে বাড়িয়ে ১৮০০ টাকা দাঁড়াবে। এ রুটের মিনি বাস বা কোস্টার ৯০০ থেকে বেড়ে ১০৫০ টাকা, মাঝারি মাপের বাস দিনে ১৫৮০ টাকার স্থলে ১৮৩০ টাকা ও রাতে ১৬২০ টাকার স্থলে ১৮৭০ টাকা এবং বড় বাসে ১৮২০ টাকার স্থলে ২১৬০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। এ ছাড়া মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ৮০০ টাকার স্থলে এক হাজার টাকা, পাজেরো গাড়ি ৭৩০ টাকার স্থলে ৯০০, কার ও জিপ ৪৫০ টাকার স্থলে ৫৪০, মোটরসাইকেল ৭০ টাকার স্থলে ৯০ টাকা হবে। সূত্র জানায়, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং আরিচা-কাজিরহাট রুটে প্রতিদিন গড়ে আট হাজার গাড়ি পারাপার হয়। অন্যদিকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার বা মাঝিরকান্দি রুটে এক থেকে তিন টন পণ্যবাহী ছোট ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ৯৮০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা, ৩-৫ টনের ট্রাক ১ হাজার ৮০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩০০; ৫-৮ টন পণ্যবাহী ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ১ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭০০ এবং ৮-১১ টনের বড় ট্রাক ও লরির ভাড়া ১ হাজার ৮৫০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ২২০ টাকা দাঁড়াবে।
"